দশম খণ্ড
বিদ্যাপতি।
তুমি তা বুঝবে না ধনঞ্জয়। যে প্রদীপ তিলে তিলে পুড়ে বুকের সমস্ত স্নেহরসকে জ্বালিয়ে অপরকে দান করে আলো, সেই প্রদীপ ধনঞ্জয়, মাত্র সেই প্রদীপই জানে এই আত্মদানের, আপনাকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেওয়ার, কী অপার আনন্দ!
রাজা।
ঠিক বলেছ কবি। আরতির প্রদীপ নিববার আগে যেমন করে শেষবার তার উজ্জ্বলতম শিখা মেলে দেবতার মুখ দেখে নিতে চায়, তেমনি করে আমার অন্তর-দেবতা শ্রীকৃষ্ণের মুখ দেখে নিতে চাইছে আমার শ্রান্ত প্রাণশিখা। তুমি এমন গান শুনাতে পার কবি, যা আমার অন্তিম সময়ে শুনতে ইচ্ছা করবে?
ধনঞ্জয়।
মহারাজ এইবার কিন্তু অরসিকের মতো কথা আরম্ভ হল এবং কাজেই আমাকে সরে পড়তে হল। (প্রস্থান)
রাজা।
ধনঞ্জয়! ধনঞ্জয়! চলে গেছে? আঃ বাঁচলাম! বিদ্যাপতি, আমায় একটু ধরো, এখানে উঠে এলাম কী করে জানি না; আর বোধ হয় এখানে থেকে উঠে যেতেও পারব না।
বিদ্যাপতি।
তুমি অমন করছ কেন সখা? তোমার কি কোনো অসুখ করেছে?
রাজা।
সখা। প্রেমের বৃন্দাবনে আমরা– আমি তুমি লছমী অনুরাধা, জন্ম জন্ম ধরে লীলা-সহচর-সহচরী। সেই প্রেমলোকের গান যেদিন তুমি শুনালে সেদিন আমার মনে পড়ে গেল আমার বিস্তৃত জন্মের কথা, মনে পড়ে গেল প্রেমলোকনাথ শ্রীকৃষ্ণকে। তোমার গানের মন্ত্রে আমি উপাসনা করতে লাগলাম রাধা-শ্যামের যুগল মূর্তি। আমি আমার উপাস্য দেবতাকে পেয়েছি, তাই তাঁর বিরহ আর সহ্য করতে পাচ্ছি না, বন্ধু। আমি যে আমার কানুর বাঁশরি শুনতে পেয়েছি।
বিদ্যাপতি।
রাজা?
রাজা।
তুমি ঠকে গেলে, বন্ধু। তুমি গড়লে তরণি আর আমি তাই চুরি করে গেলাম বৈতরণি পেরিয়ে। বিদ্যাপতি, তুমি কাঁদছ? কেঁদো না সখা! তুমিও আসবে দু-দিন পরে আমাদের চিরলীলা-নিকেতনে, বৈকুণ্ঠধামে। জানো বিদ্যাপতি, কাল সারারাত আমি ঘুমোইনি আমার প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণকে ডেকেছি আর কেঁদেছি। আজ ভোরে সেই অশান্তের আহ্বান ভেসে এল কানে। সে আমায় ডাকছে, ওরে আয় আয়; আমার প্রিয়, আমার বুকে চলে আয়। রানি বলছিলেন রাজবৈদ্যকে খবর দিতে, এমন সময় এলে তুমি ভবরোগের বৈদ্য।
No comments:
Write comments