একাদশ খণ্ড
(বিদ্যাপতির ভবন – নিশীথ রাত্রি)
[অনুরাধার গান]
মাধব! কত পরবোধব রাধা!
হা হরি হা হরি কহতহি বারবার
অব জিউ করব সমাধা॥
ধরণি ধরিয়া ধনি জতনহি বইসই
পুনহি উঠই নাহি পারা,
সহজহি বিরহিণী জগমাহা তাপিনী
বৈরী মদন-শরধারা।
অরুণ নয়ন-লোর তীতল কলেবর
বিলোলিত দীঘল কেশা।
মন্দির বাহির করইতে সংশয়
সহচরী গণতহি শেষা॥
বিদ্যাপতি :
অনুরাধা! তুমি একা এখানে গান করছ? বিজয়া কোথায়?
অনুরাধা :
জানি না ঠাকুর! তোমায় রানি ডাকছেন। একবার যাবে?
বিদ্যাপতি :
রানি – আমায় ডাকছেন? এত রাত্রে? কেন বল তো?
অনুরাধা :
ভয় হচ্ছে, না আনন্দ?
বিদ্যাপতি :
দুই-ই! রাজা শিবসিংহের স্বর্গারোহণের পর এক বৎসর কাল রানির প্রতিভূ হয়ে রাজ্য চালালাম, এই এক বৎসর অবগুণ্ঠিতা রানির মুখের দিকে চাইতে পারিনি। কেবলই ভয় হয়েছে, যদি রানির চোখে চোখ পড়ে – আর চোখ ফিরাতে না পারি। তাই নতনেত্রে – কর্তব্য করে গেছি। রাজ-সিংহাসনে দেখেছি শুধু দু-খানি নিরাভরণ রাঙাচরণ, আর মনে হয়েছে ও চরণ সত্যসত্যই সকল দেবতার আরাধেয়। এই এক বৎসর রানি আমায় কেবল আদেশই করেছেন – রানির মতো মহিমাগম্ভীর কণ্ঠে! তাই অনুরাধা, আজ এই অন্ধকার নিশীথে তাঁর ডাক শুনে ভয় আনন্দ দুই-ই হচ্ছে।
অনুরাধা :
তা হলে আমি কী বলব গিয়ে?
বিদ্যাপতি :
আমি তোমার কথার ইঙ্গিতে বুঝলাম অনুরাধা, যে আমার যাওয়া উচিত নয়। তুমি সর্বদা রানির কাছে থাক। তুমি হয়তো রানির ভাবান্তর লক্ষ করেছ। রাজা জীবিত নেই, রানিই এখন রাজ্যেশ্বরী, স্বাধীনা। – হুঁ তুমি বলো অনুরাধা, আমি যেতে পারব না। তোমাকে দিয়ে মিথ্যা বলাব না।
অনুরাধা :
ঠাকুর, একটু পা দুটো এগিয়ে দাও দেখি। থাক থাক, তোমরা পাথরের জাত, আমিই এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করি।
[গান]
নাথ, দরশ সুখে বিধি কৈল বাদ
অঙ্কুরে ভাঙল বিধি অপরাধ।
সুখময় সাগর মরুভূমি ভেল,
জলদ নেহারি চাতক মরি গেল!
[হঠাৎ ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি]
বিজয়া :
দাদা! ভীষণ বৃষ্টি নামল যে। ঘরে বৃষ্টির ছাঁট আসছে। দোর জানালাগুলো বন্ধ করে দিই?
বিদ্যাপতি :
না, খোলা থাক। অন্ধকারের কালোর সাথে মেঘের কালো মিলে কী অপরূপ কৃষ্ণমূর্তি ধারণ করেছে প্রকৃতি, দেখেছিস বিজয়া?
বিজয়া :
তুমি দেখো দাদা, আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি চললাম। [প্রস্থান]
[বিদ্যাপতির গান]
এ সখী, হমারি দুখের নাহি ওর!
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর॥
ঝম্পি ঘন গরজন্তি সন্ততি ভুবন ভরি বরিখন্তিয়া।
কান্ত পাহুন কাম দারুণ সঘনে খরশর হন্তিয়া॥
কুলিশ কত শত পাত মোদিত ময়ূর নাচত মাতিয়া,
মত্ত দাদুরি ডাকে ডাহুকি ফাটি যাওত ছাতিয়া॥
তিমির দিগ ভরি ঘোর যামিনী অথির বিজুরিক পাঁতিয়া,
বিদ্যাপতি কহে কৈসে গোঁয়ায়বি হরি বিনু দিনরাতিয়া॥
No comments:
Write comments