তৃতীয় দৃশ্য
পঞ্চশর :
শুনিতেছ, কি মধুর গান আসে ভেসে?
চৈতালি :
তোমাদের রাজার বন্দনা গাহিতেছে
বনলক্ষ্মী। বলিতে কি পার বন্ধু তুমি
কী করিছে রাজা-রানি কুঞ্জে নিরালায়?
দখিন হাওয়া :
আমি যদি চলে যাই এই স্থান ত্যজি
যা করিবে নিরালাতে তোমার দু-জন
তেমনই একটা কিছু। বেশি কিছু নহে।
চৈতালি :
বড়ো লঘু চিত্ত তুমি দক্ষিণের হাওয়া,
ডেকে আনি পুষ্পলতা সখীরে আমার
সমুচিত শাস্তি দেবে, হবে তব সাথি।
শুনিতে হবে না আর তব হা-হুতাশ।
দখিন হাওয়া :
কাজ নাই, তার চেয়ে তুমি গাহো গান,
যে গান শুনিয়া কুঞ্জ-মাঝে রাজা-রানি–
বুঝিতে পারিবে মোরা বেশি দূরে নাই,
উৎসাহ দেবার তরে নিকটেই আছি।
বুঝিতেছি সব কিছু, দেখি না যদিও
উপভোগ করিতেছি মনশ্চক্ষু দিয়ে।
চৈতালি :
তা হলে আমিও গাই উৎসাহের গান।
জ্বালাইলে কবে রানি! হায়, পরিচয়
না হতেই মনে মনে মান অভিমান
পরিচয় ঘন হলে আরও কত হবে!
প্রেমিকা তো নহি, তাই কিছু নাহি বুঝি।
বাসন্তিকা :
আঁখি-বিনিময়ে আঁখি চিনি লয় যারে
পলকে যে জিনি লয় সকল হৃদয়
সে বহু জনমের সাথি, বন্ধু, সখা।
চৈতালি! রহস্য এর তুই বুঝিবি না।
জন্মে জন্মে নব নব রূপে তার সাথে
বিরহ-মিলন, হয় নব জানাজানি।
ব্যথা দিয়ে চলে যায় জন্মান্তর পারে,
একজন চলে যায় – সাথি তার খোঁজে
আসে নব রূপ ধরি তারই পিছু পিছু।
আত্মার আত্মীয় যার সাথি প্রিয়তম
শুধু সেই জানে সখী রহস্য ইহার।
হৃদয় বরিয়া লয় হৃদি-দেবতারে।
(দূরে কোকিলের অবিরল কুহুধ্বনি)
চৈতালি :
ওই বুঝি এল তব হৃদিরাজদূত
মুহুর্মুহু কুহুস্বরে কাঁপায়ে কান্তার।
মর্মরিয়া লতাপাতা দখিনা পবন
সহসা আসিল ওই, উতলা কানন।
সহচর অনুচর দূত এল যবে
রাজাও আসিছে পিছে মনে লাগে মোর।
উষসীর আগমনে বুঝি লো যেমন
তপনের উদয়ের আর নাহি দেরি।
বাসন্তিকা :
চৈতালি! কী হবে তবে? সত্যই সে যদি
এসে পড়ে, হেরে মোরে বিরহ-বিধুরা
কী হবে, এ মুখ সখী কেমনে লুকাই,
তুই বলে দে লো সখী, কী করিব আমি!
প্রণয় মধুর – যত রহে সে গোপন,
প্রকাশের লজ্জা তার অতি নিদারুণ।
লজ্জায় মরিয়া যাব, সে যদি লো বোঝে
ইঙ্গিতেও মোর পোড়া মরমের ব্যথা!
(পঞ্চশর ও চৈতালির গান)
পঞ্চশর :
বন-দেবী এসো গহন বনছায়ে।
চৈতালি :
এসো বসন্তের রাজা নূপুর-মুখর পায়ে॥
পঞ্চশর :
তুমি কুসুম-ফাঁদ
চৈতালি :
তুমি মাধবী চাঁদ
উভয়ে :
আমরা আবেশ ফাল্গুনের
ভাসিয়া চলি স্বপন-নায়ে॥
পঞ্চশর :
কল্পলোকের তুমি রূপরানি লো প্রিয়া
অপাঙ্গে ফোটাও জুঁই চম্পা টগর মোতিয়া।
চৈতালি :
নিঠুর পরশ তব (হায়) যাচিয়া জাগে বনভূমি,
ফুলদল পড়ে ঝরি তব চারুপদ চুমি।
উভয়ে :
(মোরা) সুন্দরের পথ সাজাই
ঝরা কুসুম-দল বিছায়ে॥
দখিন হাওয়া :
তোমরা পরোক্ষে বুঝি এই ছল করি
কয়ে নিলে তোমাদেরও অন্তরের কথা।
চৈতালি :
তুমি বড়ো লঘু, বন্ধু! চলো আলাপন
করি গিয়ে দূরে মোরা কুঞ্জের বাহিরে।
(সকলের প্রস্থান)
ফাল্গুনী :
ছল করি উহাদেরে লয়ে গেল দূরে
চৈতালি তোমায় সখী। কেন নত চোখে
চেয়ে আছ? কথা কও চাহো মুখপানে।
(বাসন্তিকার গান)
অঞ্জলি লহো মোর সংগীতে
প্রদীপ-শিখাসম কাঁপিছে প্রাণ মম
তোমায়, হে সুন্দর বন্দিতে।
সংগীতে সংগীতে॥
তোমার দেবালয়ে কী সুখে কী জানি
দুলে দুলে ওঠে আমার দেহখানি
আরতি নৃত্যের ভঙ্গিতে।
সংগীতে সংগীতে॥
পুলকে বিকশিল প্রেমের শতদল
গন্ধে রূপে রসে টলিছে টলমল।
তোমার মুখে চাহি আমার বাণী যত
লুটাইয়া পড়ে ঝরা ফুলের মতো
তোমার পদতল রঞ্জিতে।
সংগীতে সংগীতে॥
No comments:
Write comments