অষ্টম খণ্ড
(রাজ-অন্তঃপুর)
[অনুরাধার গীত]
এ ধনি কর অবধান,
তোমা বিনা উনমত কান।
(কানু পাগল হল গো। তোমারে না হেরি কানু পাগল হল গো)
লছমী।
কানু পাগল হল না তুই পাগল হলি রাধা?
[অনুরাধার গীত]
শুন শুন গুণবতী রাধে,
মাধবে বাঁধিয়া তুই কী সাধিবি সাধে?
(তুই কোন সাধ সাধিবি? মাধবে বাঁধিয়া তুই কোন্ সাধ সাধিবি?)
লছমী।
সতিনকে কাঁদব! বুঝলি?
[অনুরাধার গীত]
এতহুঁ নিবেদন করি তোরে সুন্দরী
জানি ইহা করহ বিধান।
হৃদয়-পুতলি তুহুঁ সে শূন্য কলেবর,
তুহুঁ বিদ্যাপতি-প্রাণ॥
লছমী।
আ-মল! বিদ্যাপতি, বিদ্যাপতি বলে ছুঁড়ি যে নিজেই পাগল হলি! বিদ্যাপতির বিদ্যাটুকু বাদ দিয়ে তার ঘর জুড়ে বসলেই তো পারিস।
অনুরাধা।
তা হলে তোমার কী দশা হবে সখী?
লছমী।
এক কৃষ্ণকে নিয়ে ষোলো হাজার গোপিনী যদি সুখী হতে পারে, আমরা দু-জন আর সুখী হতে পারব না কেন?
অনুরাধা।
সেই প্রেমময়ী গোপিনীদের চরণে কোটি কোটি প্রণাম করি ভাই, আমরা তাঁদের পায়ের ধূলি হবারও যোগ্য নই।
লছমী।
সে কথা থাক। অনুরাধা, আর একটা কথা জানতে বড়ো সাধ হয়। তিনি কি একবারও তোকে আমার কথা জিজ্ঞাসা করেন না?
অনুরাধা।
আধবারও না।
লছমী।
না ভাই লক্ষ্মীটি, লুকোসনে। মহারাজার আদেশে আমি আজ দু-দিন রাজসভায় যেতে পাইনি। তাঁকে একবারও দেখতে পাইনি, তাঁর গান শুনিনি। মনে হচ্ছে, যেন কত জন্ম তাঁকে দেখিনি।
অনুরাধা।
আচ্ছা ভাই, তুই যদি আজ ভোরে ঠিক এইখানে এই মাধবীকুঞ্জে তাঁকে দেখতে পাস, তা হলে কী করিস?
লছমী।
আমি গিয়ে তাঁর বামে দাঁড়াই, আর তুই মিলনের পালা গান গাস।
রাজা।
রানি!
অনুরাধা।
আসি আসি, সখী, মহারাজ আসছেন।
রাজা।
যেয়ো না যেয়ো না, অনুরাধা।
লছমী।
রাজা, তোমায় এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন? তোমার চোখে মুখে যেন রক্ত নেই।
রাজা।
ঠিক মৃতের মতো না, রানি? না, ওটা তোমার চোখের ভুল। রানি আমার একটা কথা রাখবে?
লছমী।
বলো?
রাজা।
আমাকে কাল ভোরেই চলে যেতে হবে, চলে যেতে হবে দূরে বহু দূরে আমার রাজ্যের সীমান্ত পেরিয়ে। রানি আমি যখন থাকব না, তখন যেন আমার প্রিয় সখা বিদ্যাপতির কোনো অযত্ন না হয়।
লছমী।
আমি বুঝতে পারছি রাজা, তুমি অসুস্থ। তুমি একটু চুপ করে শোও, তোমার সেবা করার কর্তব্য থেকে আমায় বঞ্চিত কোরো না।
রাজা।
কর্তব্য! সেবা! বেশ তাই করো রানি! তাই করো! লোকে যা চায়, ভগবান তাকে তার সব কিছু দেন না। এই বঞ্চিত করেই তিনি টেনে নেন সেই হতভাগ্যকে তাঁর শান্তিময় কোলে। রানি যাকে ভালোবাসার কেউ নেই সে যদি ভগবানেরও চরণে আশ্রয় না পায়, তার মতো দুর্ভাগা বুঝি আর কেউ নেই।
[বিদ্যাপতির গীত]
আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লুঁ
মহারাজ! আজ আমি গান শোনাতে এসেছি। আজ আমার গানের বাঁধ, প্রাণের বাঁধ, সুরের বাঁধ ভেঙে গেছে।
রাজা।
এসো এসো বন্ধু, এসো বিদ্যাপতি!
No comments:
Write comments