ঝিলিমিলি
প্রথম দৃশ্য
[মির্জা সাহেবের দ্বিতল বাড়ির উপর-তলার প্রকোষ্ঠ। মির্জা সাহেবের ষোড়শী মেয়ে ফিরোজা রোগশয্যায় শায়িতা। সব জানালা বন্ধ, শুধু পশ্চিম দরজা খোলা। বাহিরে বৃষ্টি হইতেছে। পার্শ্বে বসিয়া মির্জা সাহেবের পত্নী হালিমা বিবি মেয়েকে পাখা করিতেছেন। বাদলায় ও বেলাশেষের অন্ধকারে ঘরের আঁধার গাঢ়তর হইয়া উঠিতেছিল। হালিমা বিবি উঠিয়া হারিকেন জ্বালিলেন।]
হালিমা :
(ছুটিয়া আসিয়া ফিরোজার মুখের কাছে মুখ রাখিলেন) কী মা! সোনা আমার!
হালিমা :
কেন মা? বড্ড আঁধার যে! ভয় করবিনে।
ফিরোজা :
উঁহুঁ। তুমি আমায় ধরে বসে থাকো। (মা-কে জড়াইয়া ধরিল) বাতি বিশ্রী লাগে।
হালিমা :
তা তো লাগবেই মা! (দীর্ঘশ্বাস গোপন করিলেন) আচ্ছা, আমি কাগজ আড়াল করে দিই। কেমন?
ফিরোজা :
না। তুমি নিবিয়ে দাও। (রোগশীর্ণ কণ্ঠে চিৎকার করিয়া উঠিল) দাও শিগগির!
হালিমা :
কেঁদো না মণি, মা আমার! এই আমি নিবিয়ে দিচ্ছি। (বাতি নিবাইতে গেলেন। ততক্ষণে কতকগুলো বাদলা পোকা আসিয়া বাতি ঘিরিয়া নৃত্য করিতেছিল। ফিরোজা তাহাই এক মনে দেখিতে লাগিল।)
ফিরোজা :
নিবিয়ো না, মা! আমি বাদলা পোকা দেখব!
হালিমা :
(হাসিয়া ফিরিয়া আসিলেন) খ্যাপা মেয়ে! আচ্ছা নিবাব না। পোকা যে গায়ে মুখে এসে পড়বে মা, বাতিটা একটু সরিয়ে রাখি।
ফিরোজা :
(চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল) না! আমি বলছি, বাদলা পোকা দেখব!
হালিমা :
(কন্যাকে চুমু দিলেন) লক্ষ্মী মা আমার! অত জোরে কথা কোয়ো না! ওতে অসুখ বেশি হয়! আমি বাতি সরাচ্ছি নে।
ফিরোজা :
(চুপ করিয়া বাদলা পোকা দেখিতে লাগিল) মা, আমায় একটা বাদলা পোকা ধরে দাও না!
হালিমা :
ছি মানিক! পোকা ছুঁতে নেই! তুই আজ অমন করছিস কেন ফিরোজা?
ফিরোজা :
(কান্নার সুরে) দাও বলছি। নইলে চেঁচিয়ে রাখব না কিছু।
হালিমা :
লক্ষ্মী, মা! কেঁদো না। এই দিচ্ছি। (একটা বাদলা পোকা ধরিয়া মেয়ের হাতে দিলেন। ফিরোজা হাতে করিয়া এক মনে বাদলা পোকা দেখিতে লাগিল।)
ফিরোজা :
এই যা! পাখা খসে গেল! আ-হা-রে! আচ্ছা মা! বাদলা পোকার খুব লাগল?
ফিরোজা :
তা হলে ছেড়ে দিই ওকে। মা, তুমি ওকে নীচে রেখে এসো (হালিমা বাদলা পোকা নীচে রাখিয়া আসিলেন) ... মা, বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, না?
হালিমা :
হাঁ মা, খুব বৃষ্টি। শুনছ না ঝমঝমানি?
ফিরোজা :
এখন যদি আমি খুব জোরে কাঁদি, আব্বা শুনতে পাবেন?
হালিমা :
ছি মা, কাঁদবে কেন? ওঁকে ডেকে পাঠাব?
ফিরোজা :
না, না, ডেকো না। মা খুব লক্ষ্মী মেয়ে! আচ্ছা মা, তুমি যদি এখন গান কর, আব্বা শুনতে পাবেন?
হালিমা :
ওরে দুষ্টু! বুঝেছি তোমার মতলব। ... না, মা, এখন কি আর গান করে, তোর আব্বা শুনলে রাগ করবেন।
ফিরোজা :
এত বৃষ্টিতে শুনতে পাচ্ছেন কিনা! মা, লক্ষ্মী মা, সোনা-মা, আস্তে আস্তে গাও না! সেই বৃষ্টি ঝরার গানটা।
হালিমা :
আচ্ছা, গাচ্ছি আস্তে আস্তে। এখন কি আর গান আসে রে ফিরোজা। সেই কখন ছেলেবেলায় গেয়েছি গান। এখানে এসেই তা ভুলতে চেষ্টা করেছি। তোর আব্বা বড্ডো রাগ করেন গান শুনলে।
ফিরোজা :
আচ্ছা মা, গান শুনেও কেউ রাগে? আব্বা আচ্ছা মানুষ যা হোক!
হালিমা :
আগে কিছুদিন রাগ করতেন না। ... গান তো প্রায় ভুলেই যাচ্ছিলাম। কেবল তোর জন্যেই আজও দু-একটা মনে আছে।
ফিরোজা :
আব্বা আগে রাগ করতেন না মা, তুমি গান করলে?
হালিমা :
না! .......... তুই এখন গান শোন।
ঝরে ঝরঝর কোনো গভীর গোপন-ধারা এ শাঙনে।
আজি রহিয়া রহিয়া গুমরায় হিয়া একা এ আঙনে।।
ঘনিমা ঘনায় ঝাউ-বীথিকায় বেণু-বন-ছায় রে
ডাহুকিরে খুঁজি ডাহুক কাঁদে রে আঁধার গহনে।।
কেয়া-বনে দেয়া তূণীর বাঁধিয়া
গগনে গগনে ফেরে গো কাঁদিয়া
বেতস-বিতানে নীপ-তরুতলে
শিখী নাচ ভোলে পুছ-পাখা টলে।
মালতী লতায় এলাইয়া বেণি কাঁদে বিষাদিনী রে,
কাজল-আঁখি কে নয়ন মোছে তমাল-কাননে।।
ফিরোজা :
মা! জানলাটা খুলে দাও। আমি মেঘ দেখব!
হালিমা :
লক্ষ্মী মা! জানলা খোলে না। ঠান্ডা লাগবে। আমি বরং একটা গান করি, তুমি শোনো।
ফিরোজা :
না মা। আর গান আমি সইতে পারব না। খোলো না মা, জানলাটা। (হালিমা দক্ষিণের জানালা খুলিতে গেলেন) ওটা না মা, ওই পুব-দিককার জানলাটা খোলো। পুবের হাওয়ায় কদম ফোটে, না মা?
হালিমা :
ও-দিককার জানলা খুললে তোর আব্বা আমায় আর জ্যান্ত রাখবেন না, ফিরোজ! এই দক্ষিণের জানলাই খুলি। (দক্ষিণের বাতায়ন খুলিলেন। দূরে বনের আভাস দেখা যাইতেছে। বৃষ্টিধারায় বন ঝাপসা হইয়া আসিতেছে।)
ফিরোজা :
(দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া পাশ ফিরিল। আবার পাশ ফিরিয়া আগেকার মতো করিয়া শুইয়া জানালার দিকে তাকাইয়া থাকিল। বোধ হয় সে কাঁদিতেছিল।) মা!
হালিমা :
মা আমার! তুই কাঁদছিস ফিরোজ?
ফিরোজা :
আচ্ছা মা, আব্বা তোমায় খুব ভালোবাসেন?
হালিমা :
জানি না। (চক্ষু মুছইলেন)
ফিরোজা :
আগে খুব ভালোবাসতেন?
হালিমা :
বাতিটা এখন সরিয়ে রাখি? তোর চোখে লাগছে, না?
ফিরোজা :
আচ্ছা রাখো। কিন্তু তুমি বলো ...
হালিমা :
(বাতি সরাইয়া রাখিলেন।) এখন একটু চুপ করে ঘুমাও তো ফিরোজা। বকলে আবার অসুখ বাড়বে।
ফিরোজা :
আচ্ছা, তুমি না-ই বললে। আমি সব বুঝি। আব্বা কক্ষনো কাউকে ভালোবাসেননি। নইলে মানুষ কখনো এমন নীরস আর নিষ্ঠুর হয়!
হালিমা :
তুই কি থামবি নে ফিরোজা? লক্ষ্মী মা আমার, কেন মন খারাপ করছ এত, বল তো! আজ যে তোকে চুপ করে থাকতে বলে গেছে ডাক্তার।
ফিরোজা :
আচ্ছা মা, কাল থেকে ওই পুব-দিককার জানলাটা খুলবে তো, তখন তো আর আব্বা বকবেন না?
হালিমা :
(শিহরিয়া উঠিলেন। কান্নায় তাঁহার গলা ভাঙিয়া আসিল।) ও কী কথা বলছিস ফিরোজ?
ফিরোজা :
কাল আর ও-জানলা খুলতে বলব না মা! (বালিশে মুখ লুকাইল।)
হালিমা :
(হঠাৎ পাথরের মতো স্থির হইয়া গেলেন। কণ্ঠ তাঁহার অশ্রুবিকৃত হইয়া উঠিল।) বুঝেছি রে হতভাগি, সব বুঝেছি। তুই আমাদের বড়ো শাস্তি দিয়ে যাবি। ... মা, এই আমি খুলে দিচ্ছি পুব-জানলা, তুই অত অধীর হসনে। (পুব-জানালা খুলিয়া দিতেই সম্মুখের বাড়ির মৃদু-আলোকিত বাতায়ন দেখা গেল। বাতায়নপথে কে যেন ছটফট করিয়া ফিরিতেছে। দূর হইতে তাহাকে ছায়ামূর্তির মতো দেখাইতেছিল। ছায়ামূর্তি নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। মনে হইল যেন এই বাতায়ন-পানেই সে অচঞ্চল দৃষ্টিতে তাকাইয়া আছে। হালিমা আড়ালে চক্ষু মুছিলেন।)
ফিরোজা :
(ব্যাকুল দৃষ্টিতে বাতায়ন-পথে তাকাইয়া রহিল।) মা, বাঁশি বাজছে না? উঁহুঁ কে যেন কাঁদছে! (অস্থির হইয়া) বাইরে কে কাঁদে মা? মা, মা, শোনো!
হালিমা :
কই মা, কিছু না। ও বৃষ্টির ঝরঝরানি। ... হুঁ ... না ...হাবিব বুঝি গান করছে এসরাজ বাজিয়ে।
ফিরোজা :
আহ! বৃষ্টিটা যদি থামত, গানটা শুনতে পেতাম ... বৃষ্টি থেমে আসছে – না মা?
হালিমা :
হাঁ মা, বৃষ্টিটা ধরে এল।
ফিরোজা :
মা – মা! এইবার শুনতে পাচ্ছি গান। আহ! একটু শব্দ না হয় যেন। মা তুমি চুপ করে শোনো। (বাতায়ন হইতে গান ভাসিয়া আসিতেছিল।)
গান
হৃদয় যত নিষেধ হানে নয়ন ততই কাঁদে।
দূরে যত পলাতে চাই, নিকট ততই বাঁধে।।
স্বপন-শেষে বিদায়-বেলায়
অলক কাহার জড়ায় গো পায়,
বিধুর কপোল স্মরণ আনায়
ভোরের করুণ চাঁদে।।
বাহির আমার পিছল হল কাহার চোখের জলে।
স্মরণ ততই বারণ জানায় চরণ যত চলে।
পার হতে চাই মরণ-নদী
দাঁড়ায় কে গো দুয়ার রোধি,
আমায় – ওগো বে-দরদি –
ফেলিলে কোন্ ফাঁদে।।
[গান শেষ হইলে বাতায়নের আলো উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিল। সেই আলোকে এক প্রিয়দর্শন তরুণের মূর্তি স্পষ্ট হইয়া দেখা দিল। সে স্থির দৃষ্টিতে এই দিকেই তাকাইয়া আছে।]
ফিরোজা :
মা – মা-মণি! ঘরের বাতিটা খুব উজ্জ্বল করে দাও। যেন আমায় খুব ভালো করে দেখা যায় ও-বাড়ি হতে। (বাহিরে কাহার পদশব্দ শোনা গেল।)
হালিমা :
ওরে ফিরোজ! বন্ধ কর, বন্ধ কর, পুব-জানালা। তোর আব্বা আসছেন। (মির্জা সাহেব গৃহে প্রবেশ করিতেই একটা দমকা হাওয়ায় প্রদীপ নিবিয়া গেল। হালিমা আবার বাতি জ্বালাইলেন।)
মির্জা সাহেব :
আর জানলা বন্ধ করতে হবে না। আমি বহুক্ষণ থেকেই তোমাদের কীর্তি দেখছি। দেখ, আর যা-ই কর, ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে চেষ্টা, কোরোনা। (হালিমা নিরুত্তর) ... আর ওই বাঁদর ছোঁড়াটাকেই বা কী বলি! এক গাছা কাঁচা বেত নিয়ে বেতিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ... (ক্রোধে বদ্ধমুষ্ঠি হইয়া দাঁত কড়মড় করিয়া উঠিলেন।) দিনরাত গান আর গান! বাঁশি আর এসরাজ! স্থিরচিত্তে একটু
‘কোরান তেলাওত’কোরান তেলাওত : পাঠ। করবার কী নামাজ পড়বার জো নেই। হতচ্ছাড়া পাজি কোথাকার! ওই বিশ্ব-বখাটে আবার বলে, পাশ করবে বি.এ.। ও তো ফেল করেই আছে। ওই রত্নের সঙ্গে দেব মেয়ের বিয়ে!
হালিমা :
দেখো, তোমার পায়ে পড়ি, আজ একটু আস্তে কথা কও, আজ ফিরোজা কেমন যেন করছে!
মির্জা সাহেব :
(পুব-দিককার জানালাটা বন্ধ করিতে করিতে) হুঁ। ... তা এমন করে জানলা খুলে তাকিয়ে থাকলে যে-কোনো আইবুড়ো মেয়েরই অসুখ করে।...দেখ, তুমিই ফিরোজার মাথা খেলে। আর ওই বুড়ো বয়সেও তোমায় গান গাওয়া অভ্যেস গেল না। কী ভুলই করেছি স্কুলে-পড়া মেয়ে বিয়ে করে!
হালিমা :
সত্যি, এ ভুল না হলে দুইজনই বেঁচে যেতাম। আমি এ কথা-ভাবতেও পারিনে যে, কোনো কোনো গ্র্যাজুয়েট গোঁড়ামিতে কাঠ-মোল্লাকেও হার মানায়।
মির্জা সাহেব :
শরিয়তের বিধি-নিষেধ মানাকে তুমি গোঁড়ামি মনে কর, এ অভিযোগ তো বহুবার শুনেছি, হালিমা। আর কোনো নতুন কথা শোনাবার থাকে তো বলো।
হালিমা :
আছে। তোমার মতো শরিয়তের টিন-বাঁধানো হৃদয়ে তা কি লাগবে? ...একটু আগে গানের খোঁটা দিচ্ছিলে। কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছ যে,আমি গান গাইতে পারি জেনেই তুমি আমায় বিবাহ করে কৃতার্থ হয়েছিলে!
মির্জা সাহেব :
ভুলিনি সেকথা। কিন্তু তখন জানতাম না যে তোমার গান শুধু চোখের জল, শুধু ব্যথা। কেন গান শরিয়তে নিষিদ্ধ, তা আমার চেয়ে কেউ বেশি বুঝবে না! শরিয়তে যিনি সংগীত নিষিদ্ধ করেছিলেন, তিনি জানতেন এর ব্যথা দেওয়ার পীড়া দেওয়ার শক্তি কত।
হালিমা :
আমি এও জানি, যিনি এই শরিয়তের স্রষ্টা, তিনি গান শুনে আনন্দও পেয়েছেন। যাক, তর্ক করবার স্থান এ নয়। মেয়েটাকে একটু শান্তিতে মরতে দেবে কি?
মির্জা সাহেব:
দেখ, জীবনে হয়তো শান্তি দিইনি তোমাদের। আমার বিশুষ্ক জীবনে তোমাদের জন্যে হাসির ফুল ফোটাতে পারিনি, শুধু কাঁটাই ফুটিয়েছি। কিন্তু মরণেও তোমাদের অশান্তি হানব, এত বড়ো গালি আমায় না-ই দিলে!
(হালিমা চমকিয়া উঠিলেন, ফিরোজা পাশ ফিরিয়া জলসিক্ত চোখে তাহার বাবার দিকে তাকাইল – মির্জা সাহেব পায়চারি করিতে লাগিলেন।)
ফিরোজা :
আব্বা! আমার পাশে এসে বসো।
মির্জা সাহেব :
(কাঁপিয়া উঠিলেন)...হালিমা! তুমি ফিরোজাকে দেখো, আমি ডাক্তার ডাকতে চললাম।
ফিরোজা :
আব্বা! আব্বা! দেখছ না কীরকম ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল আবার। তুমি যেয়ো না। আমি আর ওষুধ খাব না। একটু কাছে এসে বসো আজ লক্ষ্মীটি।
মির্জা সাহেব :
(হঠাৎ শুষ্ক হইয়া উঠিলেন।) কিন্তু আমি থাকলে তো তোমার অসুখ আরো বেড়ে উঠবে মা!
ফিরোজা :
না, আজ আর বাড়বে না। তুমি এসো (মির্জা সাহেব তাহার শয্যাপার্শ্বে বসিয়া তাহার ললাটে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন) ... আব্বা, আজ আমি খুব যা-তা বকব, তুমি কিছু বলবে না বলো।
মির্জা সাহেব :
আচ্ছা মা, বলো।
ফিরোজা :
তুমি ওই পুব-জানলাটা খুলতে দাও না কেন?
মির্জা সাহেব :
(হঠাৎ কঠোর হইয়া উঠিলেন) ও ব্যাটা পাজি, নচ্ছার, বাঁদর!...কিন্তু মা, তুমি ভালো হয়ে ওঠো। ও যদি বি. এ. পাশ করতে পারে এবার, তাহলে ওই বাঁদরের গলাতেই মোতির মালা দেব – এও তো বলে রেখেছি।
ফিরোজা :
কিন্তু আমি তো আর ভালো হব না আব্বা।
মির্জা সাহেব :
(শিহরিয়া উঠিলেন) না, মা, ভালো হবে। এখনই তো ডাক্তার আসবে।
ফিরোজা :
উঁহুঁ, কিছুতেই ভালো হব না আমি।...আচ্ছা আব্বা, তুমি ওকে এ-বাড়ি আসতে দাও না কেন?
মির্জা সাহেব :
(হঠাৎ বিছানা হইতে উঠিয়া চিৎকার করিয়া) আমি ওকে খুন করব। শয়তান আমার মেয়েকে খুন করেছে।
(বাহির দ্বারে করাঘাত শোনা গেল)
হাবিব :
আমি এসেছি। আমায় খুন করুন। ... মা, একটিবার দোর খুলে দিন।
মির্জা সাহেব :
খবরদার! কেউ দোর খুলো না। বেরোও পাজি এখান থেকে।
হাবিব :
পাশের খবর বের হয়েছে।
হাবিব :
এখনও খবর পাইনি। তার করেছি। হয়তো এখনই খবর আসবে।
মির্জা সাহেব :
মিথ্যাবাদী! আগে খবর আসুক, তারপর এসো। এখন বেরোও। মেয়ের অসুখ বেড়েছে।
হালিমা :
আহা, দাও না বাছাকে আসতে। একটু দেখে যাবে বই তো নয়! কদিন থেকে ছেলেটা যেন ছটফটিয়ে মরছে।
মির্জা সাহেব :
হাঁ, আর সেই দুঃখে নতুন নতুন গান গাওয়া হচ্ছে। চুপ করো তুমি। (চিৎকার করিয়া) এখনও দাঁড়িয়ে আছ?
হাবিব :
আছি। আমায় খুন করবেন বলেছিলেন। খুন করুন, তবুও একবার দোর খুলুন মির্জা সাহেব।
মির্জা সাহেব :
দেখেছ ব্যাটার মতোলব। নিশ্চয় সাথে পুলিশ নিয়ে এসেছে। আমায় বলিয়ে নিতে চায় যে, আমি খুন করব বলেছি। আমি কখখনো খুন করব বলিনি, তুমি লক্ষ্মী-ছেলের মতো বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ো।
ফিরোজা :
কেন এত অপমান সইছ আমার জন্যে, তুমি যাও। আমি তোমায় পেয়েছি।
হাবিব :
কিন্তু, আমি তো পাইনি।
ফিরোজা :
কাল পাবে। আমি আজ তোমার উদ্দেশে যাব পুব-জানলা দিয়ে। তুমি তোমার বাতায়নের ঝিলিমিলি খুলে রেখো।
হাবিব :
কিন্তু তোমার বাতায়ন তো রুদ্ধ।
ফিরোজা :
যখন যাব তখন আপনি খুলে যাবে।
ফিরোজা :
যাও। যাওয়ার কালে আমার ঝিলিমিলি-তলে সেই যাওয়ার গানটা শুনিয়ে যাও।
[হাবিবের গাহিতে গাহিতে প্রস্থান]
শুকাল মিলন-মালা, আমি তবে যাই।
কী যেন এ নদী-কূলে খুঁজিনু বৃথাই।।
রহিল আমার ব্যথা।
দলিত কুসুমে গাঁথা,
ঝুরে বলে ঝরা পাতা –
নাই কেহ নাই।।
যে-বিরহে গ্রহতারা সৃজিল আলোক,
সে-বিরহে এ-জীবন জ্বলি পুণ্য হোক।
চক্রবাক চক্রবাকী
করে যেমন ডাকাডাকি,
তেমনই এ-কূলে থাকি
ও-কূলে তাকাই।।
ফিরোজা :
মা! মা! আমার কেমন করছে! মাগো, তুমি আমায় ধরো! আব্বা, তুমি যাও। তোমায় ভালো লাগে না। ... মা! মা! এত বাতি জ্বলে উঠল কেন! (মূর্ছিত হইয়া পড়িল)
হালিমা :
ওগো, তোমার পায়ে পড়ি, যাও ডাক্তারকে দেখ একটু! মা! সোনা মা আমার! লক্ষ্মী মা! ফিরোজ!
মির্জা সাহেব :
ফিরোজ! মা! তুই ফিরে আয়! আমি হাবিবকে ফেরাতে যাচ্ছি।
[বিদ্যুৎবেগে বাহির হইয়া গেলেন।]
No comments:
Write comments