ষষ্ঠ দৃশ্য
শচীমাতা :
বউমা! একী মা লক্ষ্মী। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছ? ছি মা! কাঁদতে নেই, নিমাই-এর আমার অমঙ্গল হবে। এইমাত্র খবর পেলুম, নিমাই কাল গয়া থেকে ফিরে আসবে। পাগলি মেয়ে, বললাম দুদিন মায়ের কাছে গিয়ে থেকে এসো, তবু খানিকটা মন ভালো থাকবে। তা আমায় ছেড়ে যেতে চাইল না।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
মা, উনি যে যাবার সময় তোমার কাছে থেকে তোমার সেবা করতে বলে গেছেন। আর, তোমাকে মা পেয়ে আর কেউ যে আমার মা ছিল, তা ভুলেই গেছি।
শচীমাতা :
ও-কথা বলিসনে মা। আমার বেয়ান শুনতে পেলে আমায় ডাইনি বলবে। - এই কাঞ্চনা আসছে – তোমরা দুটি সখীতে বসে গল্প করো – হ্যাঁ মা, আর ওকেও বলো যে আমার নিমাই কাল ফিরে আসবে – আমি যাই – মালিনী সইকে, সর্বজয়াকে জানিয়ে আসি খবরটা।
[কাঞ্চনার গান]
প্রথম যৌবনে এই প্রথম বিরহ গো।
(তাই) সহিতে না পেরে রাই, কাঁদে অহরহ গো।
(ফুল) শয্যারে মনে হয় কন্টক শয্যা
কাঁদিতে পারে না, যত ব্যথা তত লজ্জা,
প্রবাসী বঁধুরে ঘরে আসিতে কহো গো॥
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কাঞ্চনা সই, তোর গান এখন রাখ। শোন, মা বলে গেলেন, উনি কাল আসবেন।
কাঞ্চনা :
(সুরে) কাল কাল করে গেল কতকাল
কালের নাহিকো শেষ –
কাল নাই যথা বন্ধুরে লয়ে
যাব আমি সেই দেশ।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
সত্যি বলছি, মা এইমাত্র ছোটো মাসিকে খবর দিতে গেলেন। মা-র সে কী খুশি ভাই, যত হাসেন তত কাঁদেন।
কাঞ্চনা :
আমার কিন্তু না-আসা পর্যন্ত বিশ্বাস হয় না, ভাই। যদি আসেন তাহলে বুঝব এবার নবদ্বীপে এসে ঠাকুর ভদ্রলোক হয়েছেন। ভদ্রলোকের যে কথা রেখে চলতে হয় এ জ্ঞান তো ওঁর ব্রজে ছিল না, আর ও-জ্ঞান হবেই বা কোত্থেকে! গয়লা ছোঁড়াদের সঙ্গে গোরু চরিয়ে কে কবে ভদ্রলোক হয়েছে?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
না ভাই লক্ষ্মীটি, ঠাট্টা রাখ। এখন কী করব বল দেখি? আমার বুকের ভিতর যেন কেমন করছে, শরীর কাঁপছে।
কাঞ্চনা :
করবে আর কী। এসো, দুই সখীতে গলা ধরে ধেই ধেই করে নাচি। এতদিন যে বিরহ আমাদের কাঁদিয়েছে, সেই বিরহের বুকে বসে তার দাড়ি উপড়াই।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তোর কথা আমার কিছু ভালো লাগছে না, কাঞ্চনা। কাল যদি ভোর না হতেই এসে পড়েন, তখন ফুল পাব কোথা। এখনও সন্ধ্যা লাগেনি, তুই পাড়ায় গিয়ে কার বাড়িতে কী ফুল পাওয়া যায়, দেখ না লক্ষ্মীটি।
কাঞ্চনা :
আচ্ছা, আমি চললাম। আমি কিন্তু বেছে বেছে সেই ফুল আনব, যে ফুলে কাঁটা আছে। (প্রস্থান)
শচীমাতা :
এই ঘরে বেয়ান, এই ঘরে তোমার মেয়ে। সর্বজয়া, মালিনী সই, তোমরাও এসো বউমার ঘরে – বউমা, বউমা, দেখো আমার দুই বেয়ানকে, তোমার মাকে, খুড়িমাকে ধরে এনেছি।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
একী! মা! খুড়িমা!
মহামায়া :
আহা! মা আমার এই কদিনে কী রকম শুকিয়ে গেছে, দেখেছিস বিধু।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আমার কোলে বসে থাকতে লজ্জা করচে মা, নীচে নেমে বসি।
মহামায়া :
ওরে তোর কোলে ভগবান যদি সন্তান দেন, তখন বুঝবি সন্তানকে কোলে নিয়ে মায়ের কত সুখ।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আমি বুঝি এখনও খুকি আছি? ওই দেখো ছোটো মাসিমা, রাঙা মাসিমা আসছেন এ-ঘরে।
শচীমাতা :
ওতে লজ্জার কী আছে বউমা? নিমাই যেদিন বিয়ে করে প্রথম তোমায় নিয়ে এল ঘরে, আমিই যে সেদিন লজ্জার মাথা খেয়ে অত লোকের মাঝে তোমায় কোলে নিয়ে নেচেছিলাম। বউমা, এই যে, তোমার মাসিমারা এসেছেন, প্রণাম করে ওঁদের পান এনে দাও।
সর্বজয়া, মালিনী :
(একজনের পরে অন্যজনে) থাক থাক মা, বেঁচে থাকো চির-এয়োতি হয়ে।
যাদব :
দিদি! দিদি! কাল জামাইবাবু আসছেন। আমাকে যাবার সময় বলে গেছিলেন, তোমার জন্য লাল শাড়ি আনবেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(চুপে চুপে) আঃ! যাদব, চুপ কর।
নিমাই :
মা! মা! আমি এসেছি – আর তোমার জন্য গয়া থেকে এনেছি কৃষ্ণপ্রেম।
No comments:
Write comments