Search This Blog

Theme images by MichaelJay. Powered by Blogger.

Blog Archive

Thursday, December 8, 2016

লাট-প্রেমিক আলি ইমাম

লাট-প্রেমিক আলি ইমাম


হায়দ্রাবাদের নিজামের প্রধানমন্ত্রী সার সৈয়দ আলি ইমাম বিলাতে গত ১১ মার্চ রাত্রে লর্ড এবং লেডি রিডিং-এর সম্মানার্থে এক ভোজ দিয়াছিলেন। সেই ভোজসভায় বক্তৃতা দিবার সময় তিনি মি. মন্টেগুকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাইয়া বলেন, মি. মন্টেগু ভারতের কল্যাণের জন্য, মুক্তির জন্য প্রবল প্রতিবন্ধক সত্ত্বেও ভীষণ যুদ্ধ (অবশ্য বাকযুদ্ধ) করিয়াছেন। লর্ড হার্ডিঞ্জ আশ্চর্য তৎপরতার সহিত গত ১৯১৪ সালের মহাবিপদের সময় ভারতীয় সৈন্যদিগকে চটপট আসরে নামাইয়া ভারতীয়দিগের ভীষণ রাজভক্তির কথা সপ্রমাণ করিয়াছেন। লর্ড রিডিং ভারতের লাটগিরি করিতে স্বীকৃত হইয়া ব্যক্তিগত স্বার্থত্যাগের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছেন! তাঁহার এই নিঃস্বার্থ বলিদানে ভারত কৃতার্থ হইয়া যাইবে! ভারতের বর্তমানে যে সংকটাপন্ন অবস্থা, তাহাতে এই রকম একজন গুণসম্পন্ন প্রতিভান্বিত ইংরাজ রাজপুরুষের ভয়ানক দরকার ছিল। তিনি লর্ড রিডিংকে ভরসা দিয়া আরও বলেন যে, ভারতের জন্য বা সাম্রাজ্যের মঙ্গলের জন্য যাহা কিছু করিতে হইবে, তাহাতেই তিনি (না ডাকিতেই) গিয়া হাত লাগাইতে পিছ-পা নন।... লর্ড রিডিং প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘আমি সার আলি ইমামের সব নয়। (অ্যাঁ,– যার জন্যে চুরি করি, সেই বলে চোর!) যে কোনো মহাপুরুষই হউন, ত্রিশ কোটি লোকের উপর হর্তাকর্তা বিধাতা হওয়াটা তাঁহার পক্ষে বড়ো সোজা কথা নয়। পরম করুণাময় চরম প্রসন্ন না হইলে কোনো ভায়ার এ (গয়াসুরের) পাদপদ্ম লাভ হয় না। (অত্যধিক আনন্দে ‘মনে মনে’ ঈশ্বরকে নমস্কার!) মস্ত বড়ো একটা বিরাট রকমের মহাপদ-প্রাপ্তির জন্য আমি লাটের মলাটে নিজের নাম লিখাইতে রাজি হই নাই, আমাকে ওই পদের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত লোক ভাবিয়া লাট নিযুক্ত করা হইয়াছে বলিয়া আমার এই স্বার্থত্যাগ!’ লর্ড রিডিং এইখানেই না থামিয়া হুড়মুড় করিয়া আরও বলিতে থাকেন যে, তিনি যে এত বিস্তৃততর একটা স্থান ও কাজ দেখাইবার সুযোগ পাইলেন ইহার জন্য তিনি গর্বিত। এইবার তিনি দেখাইয়া দিবেন যে, তাঁহার কার্যক্ষমতা কত বেশি। এতদিন তাঁহাকে আইন অনুসারে বিচার নিষ্পত্তি করিতে হইয়াছে, কিন্তু এইবার তিনি বিবেক দিয়া বিচার করিতে পারিবেন। তাই এই ভারতত্রাতার পদমঞ্জুরি। তিনি ‘বহু আশা করিয়া’ ভারত-যাত্রা করিতেছেন যে, ভারত পৌঁছিয়াই তিনি দেশব্যাপী এমন এক জলবায়ুর সৃষ্টি করিয়া ফেলিবেন, যাহাতে গবর্নমেন্ট আর ভারতীয় জনসাধারণের মধ্যে পরস্পরের একটা সহানুভূতিপূর্ণ বোঝাপড়া বা লেখাপড়া হইয়া যাইবে। জাতিবর্ণ নির্বিশেষে প্রজাপালন করিবেন বলিয়া তিনি মহৎ আশা করেন! আশ্চর্য কথাই কী না শুনিলাম! তাঁহার স্কন্ধে কত বড়ো দায়িত্বের জোয়াল চড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে ভাবিয়া তিনি প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় কাতর মিনতি জানাইবেন, যেন তিনি তাঁহার ওই গর্দানের জোয়ালোপযুক্ত হন!


মি. মন্টেগু তখন উঠিয়া নিজামের, তাঁহার প্রধানমন্ত্রী সার আলি ইমাম সাহেবের ও তাঁহার বেগম সাহেবার স্বাস্থ্য কামনা করিয়া ...নিজাম যে গত যুদ্ধের সময় লোক-লশকর গোলাগুলি দিয়া ইংরাজের ইজ্জত রক্ষা করেন, তজ্জন্য খুব গরমাগরম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। যদিও ভারতের অবস্থা এখন জটপাকানো জটার মতোই জটিলতাপূর্ণ, তবুও তাঁহার আশা আছে, এ-সব জট খুলিয়া যাইবে, এবং ইংরাজ ও ভারতীয়দের মধ্যে একটা নূতন যুগের নব প্রেরণার আজানুলম্বিত বাহুর আবির্ভাব হইয়া পরস্পরকে নিবিড় প্রেমে জড়াজড়ি করিয়া কষিয়া বাঁধিবে!


ইহার উপরে আর আমাদের কথা নাই! এ যেন একেবারে ‘দুধকে দুধ, জলকে জল!’


সবাই তো নিজের নিজের মনের মতন কথাগুলি দিব্যি আওড়াইয়া গেলেন, কিন্তু যাহাদের জন্য এত নাড়ির টান ইঁহাদের, তাহাদের কেমন লাগিল বা লাগিবে সেটা কি ভাবিয়া দেখিয়াছেন? রাজতন্ত্র, স্বেচ্ছাতন্ত্র বা আমলাতন্ত্রের মজাই হইতেছে এই যে, কর্তারা কেবল নিজের দিকটাই দেখেন। নিজেদের সুখ-সুবিধাটাই তাঁহাদের লক্ষ্য – বাকি সব চুলোয় যাক, তাঁহাদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই!


সার আলি ইমাম এখন লাট হইবার আশায় কত রকম ঢলানই ঢলাইবেন, এবং কর্তাদের মনস্তুষ্টির জন্য কত রকমেই না পুচ্ছ নাড়িয়া নিজের কৃতজ্ঞতা ও প্রভুভক্তি জানাইবেন, কিন্তু সে আশা কি সফল হইবে শেষ পর্যন্ত? ভারতের বিনা-জবাবদিহির লাট-মসনদে বসা লইয়াও তিনি যাঁহার নিঃস্বার্থ ত্যাগ দেখিয়া বিনাইয়া-বিনাইয়া গুণ ব্যাখ্যা করিলেন বা খোত্‌বা পড়িলেন, তিনিই কি না তাঁহার মুখের উপর এমন অপমানটা করিয়া বসিলেন, “না ভাই, না এতে আমার স্বার্থত্যাগের কোনো সুগন্ধই নাই – আমি বুদ্ধদেব নই; ত্রিশ কোটি মানুষ-মেষের রাখাল, পঞ্চাশটি হাজার করে টাকা মাসোহারা (যা দিয়া ইংলণ্ডে দু-পাঁচটা লয়েড জর্জ কিনতে পাওয়া যায়), এ কী ভাই সবই ফাঁকি , স লভ্য কি গেছ ভুলে?” লর্ড রিডিং সাংঘাতিক লোক, তাই খাঁটি সত্যকথা (তা যত বড়োই অপ্রিয় হউক না) একেবারে মুখের উপর চাঁচাছোলা ভাষায় বলিয়া দিয়াছেন! এঁদের কাছে বাবা ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় নাই, সোজা কথা। সোজাসুজি বলিয়া দেওয়া, – ব্যস! ইহাতে তুমি রাগো, তো ঘরে বেশি করিয়া ভাত খাইবে! এ তো আর এদেশি রাজা-মহারাজ নন যে, দুটো চাটুবাক্যের আঁচ দিয়াই তাঁহাদিগকে ননীর মতন গলাইয়া ফেলিবে!


সার আলি ইমামকে শুধু জিজ্ঞেস করি, আমাদের গায়ের দাগগুলো কী এমন করিয়া মাখন ডলিলেই এত শীঘ্র মিলাইয়া যাইবে? –


  


‘সেথা যে বহে নদী নিরবধি সে ভোলেনি,


তারই যে স্রোতে আঁকাবাঁকা বাঁকা চোখা বাণী,


এখনও গুঁতোর রেখা আছে লেখা পিঠের কূলে! –


আজই জী সবি ফাঁকি, সেকথা কী গেছ ভুলে?’

No comments:
Write comments

Interested for our works and services?
Get more of our update !