দশম দৃশ্য
(নিমাই-এর ভবন)
[একজন ভিখারি দ্বারে দাঁড়াইয়া গান করিতেছে –]
বিদায় দে মা, একবার দেখে আসি
(যে)
বৃন্দাবনে রাখাল সনে কালো শশী বাজায় বাঁশি॥
সারাদিনের কাজের মাঝে
দেখি যে সেই রাখাল-রাজে
(ওমা)
বাজে শুনি নিশীথ রাতে তারই বাঁশি মন-উদাসী॥
শচীমাতা :
বাবা, তোমার পায়ে পড়ি, আমার বাড়িতে এসে রোজ রোজ ওই গান গেয়ো না। তোমার যদি অন্য গান জানা না থাকে, তোমায় গান করতে হবে না, এমনি ভিক্ষা পাবে।
ভিখারি :
মা গো! শ্রীকৃষ্ণ জানেন, আমি ইচ্ছা করে এ গান গাই না তোমার বাড়িতে। তোমার বাড়ির দোরে এলেই আমার দু-চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে। কে যেন জোর করে আমায় এই গান গাওয়ায়।
ঈশান :
দেখো বাবাজি বৈষ্ণব, অপরাধ হয় হবে, কিন্তু ফের যদি এসে ওই গান গাও, আমি তোমার গাবগুবাগুব ভেঙে, ঝোলা ছিঁড়ে, টিকি উপড়ে, ন্যাড়া মাথায় ঘোল ঢেলে ছাড়ব। ত্রিসংসারের লোক কি জোট পাকিয়েছে এই সোনার সংসার ছারেখারে দেওয়ার তরে? একে মনসা, তায় ধুনোর গন্ধ। এমনেই দাঠাউরের মুখে ঘর ছাড়ব রব লেগেই আছে – তার ওপর –
বিষ্ণুপ্রিয়া :
ঈশান দা!
ঈশান :
রও দিদিলক্ষ্মী। তুমি চোখ রাঙিয়ো না, এ বাড়িতে আমি বেহ্মা বিষ্ণুকে ভয় করি না। এই সোনার সংসারে আগুন লাগাবার জন্য যত হনুমান লেগে পড়েছে। সব হনুমানের আমি ল্যাজ কাটব তবে আমার নাম ঈশান।
নিমাই :
মা! মা! আমার দাদা ফিরে এসেছেন। এই দেখো, আমার দাদা বিশ্বরূপ।
শচীমাতা :
নিমু! কী বললি! আমার বিশ্বরূপ ফিরে এসেছে? এই কি আমার বিশ্বরূপ, আমার হারানো মানিক?
নিত্যানন্দ :
হ্যাঁ মা, আমিই তোমার বিশ্বরূপ। মন্দ লোকে আমায় মাতাল অবধূত বলে, আর দুষ্ট লোকে বলে নিত্যানন্দ।
শচীমাতা :
যে যা বলে বলুক তুই-ই আমার বিশ্বরূপ, আয় বাপ আমার কোলে আয়। ওরে! এত সুখ কি আমার সইবে? নারায়ণ! নারায়ণ!
নিমাই :
দেখলে মা, আমি গয়ায় না গেলে কি দাদা আসতেন, না তুমিই বিশ্বরূপ দেখতে পেতে?
শচীমাতা :
ওরে আমি বিশ্বরূপ দেখতে চাইনে। আমার কোল জুড়ে এমনি শিশু হয়ে, মানুষ হয়ে তোরা থাক, ওই আমার স্বর্গ মোক্ষ সব। যাক বাবা, আমার খ্যাপা নিমাই এত দিন অসহায় ছিল, এখন তুমিই তাকে দেখো। এতদিনে নারায়ণ আমার নিমুর জন্য দুর্ভাবনা দূর করলেন।
নিত্যানন্দ :
দোরের আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন আর কাঁদছেন, ও মা লক্ষ্মীটি কে মা? – ও কী মা, তোমার চোখে জল কেন? তোমার লুকিয়ে থাকবার কোনো প্রয়োজন নেই, মা লক্ষ্মী। এইবার যে তোমারও প্রকাশের দিন এল। মা, এসো এসো, একবার নয়ন ভরে যুগল-মিলন দেখি।
শচীমাতা :
লজ্জা কী বউমা, এসো, এ যে আমার নিমুর দাদা, এসে প্রণাম করো।
নিত্যানন্দ :
দোহাই মা লক্ষ্মী, ওটি হতে দিচ্ছিনে। আমার পায়ের ধুলো অত সস্তা নয়। ওই পদ্মফুলের পাপড়ির মতো হাতে কি এই অবধূতের পায়ের ধূলো লাগাতে আছে। যে হাত দিয়ে নারায়ণের সেবা হয়, সেই হাতে পায়ের ধূলা! একবার নদের চাঁদের বামে গিয়ে দাঁড়াও তো মা, আমার সন্ন্যাস সার্থক হোক, জীবন ধন্য হোক দেখে। ওকী, পালালে? আচ্ছা মা লক্ষ্মী, আজ পালালে পালাও, কিন্তু যুগল-মূর্তি আমি দেখবই।
শচীমাতা :
ওমা! ছেলেকে কোলে নিয়ে বসেই আছি, খেতে যে দিতে হবে তা মনেই নেই। আয় বাপ, তোরা দু-ভাইয়ে এসে খাবি। ঈশান!
ঈশান :
(অশ্রু গদগদ কণ্ঠে) মা?
শচীমাতা :
একী বাবা ঈশান, তুমি অমন ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে কেন? এ যে আমার বিশ্বরূপ, আমার বিশু, নিমাই ওকে ধরে এনেছে। চিনতে পারছ না? আমি দেখি গিয়ে কী আছে ঘরে।
ঈশান :
চিনেছি, মা। তবে আর কাউকে বিশ্বাস হয় না। তুমি যাও মা, আমি জায়গা করে দিচ্ছি।
নিত্যানন্দ :
ঈশানদা, আমাকে সন্দেহ হচ্ছে বুঝি?
ঈশান :
সত্যি করে বলো দেখি, তুমি কে? তুমি বিশ্বরূপ না বিষ-রূপী কেউ?
নিমাই :
ঈশানদা-র দিবারাত্রির সন্দেহ আর ভয়। এ বাড়িতে যে আসে তাকেই সে চোর বলে সন্দেহ করে।
নিত্যানন্দ :
ওর সন্দেহ ভুল নয় কানাই – থুড়ি – প্রভু, থুড়ি নিমাই। সোনার গৌরকে চুরি করার জন্যে ত্রিভুবনের চোর যে নদিয়ায় এসে জুটবে, তাতে আর সন্দেহ কী?
ঈশান :
ঠিক – ঠিক বলেছে সন্ন্যাসী ঠাউর। শুধু চোর-ডাকাত বাটপাড়-জোচ্চোরে নদিয়া ভরে উঠল – সকলের চোখ আমাদের এই সোনার গৌরাঙ্গের উপর। ডাকিনী-যোগিনী, ভূত-পেরেত, পিশাচ,যক্ষি-রক্ষি সব যেন জোট বেঁধে এসেছে। কী বলব, আমার হাতের খেঁটে লাঠি আমার হাতেই রইল, তা দিয়ে একটা মাথা ভাঙতে পারলেও আমার মনের জ্বালা কিছু কমত। যাই, খাবার জায়গাটা করে দিই গিয়ে।
নিত্যানন্দ :
(গান)
কানাইরে কই তোর চূড়া বাঁশরি!
তুই নাকি সেই নন্দদুলাল
এলি নদিয়ায় ব্রজ পাশরি?
নিমাই :
(গান)
কী পুছসি আমারে ভাই
এবার চূড়া বাঁশরি নাই।
ব্রজের খেলা বাঁশির তান
নদের খেলা হরি-গান;
ব্রজের বেশ ধড়া চূড়া, নদের বেশ কৌপীন পরা
ব্রজের খেলা রাখাল হয়ে, নদের খেলা ধূলি লয়ে।
নিত্যানন্দ :
(গানে) নদিয়াতে বিষ্ণুপ্রিয়া, ব্রজের রাই কিশোরী॥
No comments:
Write comments