একাদশ দৃশ্য
(নিমাই আহার করিতেছেন, শচীদেবী সম্মুখে বসিয়া–বিষ্ণুপ্রিয়া পরিবেশন করিতেছেন।)
শচীমাতা :
নিমাই, তুই খাবার অন্য দিকে চেয়ে কী ভাবিস বল তো? ভাবতে হয়, খাওয়া শেষ হলে ভাবিস।
(আড়ালে)কাঞ্চনা :
মা কি কিছু বুঝতে পারেন না সই?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কী বুঝতে পারেন না, কাঞ্চনা?
কাঞ্চনা :
তুমি যখন পরিবেশন কর, তখন উনি খাওয়া ভুলে হাঁ করে তোমাকেই গিলতে থাকেন দুচোখ দিয়ে। এরই মধ্যে চোখের মাথা খেয়েছ? তাও দেখতে পাও না?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাঃ, তুই কী যে বলিস কাঞ্চনা?
কাঞ্চনা :
হ্যাঁ গো হ্যাঁ, তোমার পায়ের পাঁইজোরের শব্দ শুনলেই উনি উৎকর্ণ হয়ে ওঠেন। দেখছ না, এর মধ্যে তো একশোবার মুখের গ্রাস হাতে নিয়ে তোমাকে আড়চোখে দেখে নিলেন। মা ধমকে তাঁর এই মধুর ভাবটা নষ্ট করে দিলেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
পোড়ামুখী, আস্তে, মা শুনতে পাবেন।
শচীমাতা :
বাবা নিমাই, কাল রাত্রে আমি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি।
নিমাই :
কী স্বপ্ন, মা বলো।
শচীমাতা :
তুই আর নিত্যানন্দ দুইজনে যেন পাঁচ বছরের ছেলে হয়ে হুল্লোড় করে বেড়াচ্ছিস বাড়িতে। এমন সময় দুইজন যেন ঠাকুর ঘরে ঢুকলি। তুই হাতে করে বলরাম নিয়ে বেরিয়ে এলি, আর নিত্যানন্দ বেরিয়ে এল হাতে শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে। তারপর আমার সামনে চারজন মিলে মারামারি হুল্লোড় করতে লাগলি। বলরাম আর কৃষ্ণ যেন বলছেন, তোমরা এ ঘর থেকে বেরোও। এ ঘরের ক্ষীর ননী দই সন্দেশ এসব আমাদের। তোমরা কেন ভাগ বসাতে এসেছ এখানে? নিতাই বললে – সে কাল আর নেই ঠাকুর – যে কালে ক্ষীর ননী লুটে খেয়েছ – এখন তোমরা বেরোও – এ গোপের বাড়ি নয়, ব্রাহ্মণের বাড়ি। বলরাম বললেন, – তা হলে আমাদের দোষ নেই, আমরা কিন্তু মেরে তাড়াব তোমাদের। নিতাই বললে তোমার শ্রীকৃষ্ণকে আমার ভয় নেই। গৌরচন্দ্র বিশ্বম্ভর আমার ঈশ্বর। এই বলে চারজনে কাড়াকাড়ি করে ঠাকুরঘরের সব খাবার খেতে লাগল। কেউ কারুর মুখের, কেউ কারুর হাতের খাবার কেড়ে নিয়ে খেতে লাগল। এমন সময় নিতাই ডেকে উঠল – ‘মা, আমার বড়ো খিদে পেয়েছে, খেতে দাও, ওরা সব কেড়ে খেয়ে নিলে।’এমন সময় ঘুম ভেঙে গেল।
নিমাই :
মা, তুমি অপূর্ব স্বপ্ন দেখেছ। এ স্বপ্নের কথা কাউকে বোলো না যেন। তোমার ঘরের ঠাকুর বড়ো জাগ্রত। উনি যে প্রত্যক্ষ দেবতা সে বিশ্বাস আমার আরও দৃঢ় হল তোমার স্বপ্নের কথা শুনে। অনেকবার আমি দেখেছি, মা, ঠাকুরঘরের নৈবেদ্যের সামগ্রীর প্রায় অর্ধেক থাকে না। কে যেন খেয়ে চলে যায়। তোমার বউ-এর ওপর আমার সন্দেহ ছিল, আমি লজ্জায় এতদিন বলিনি। এখন দেখছি প্রত্যক্ষ ঠাকুরই নৈবেদ্যে খান। যাক, ঠাকুর তোমার বউমাকে বাঁচালেন, তোমার বউ-এর ওপর মিথ্যা সন্দেহ এতদিনে আমার ঘুচল।
শচীমাতা :
ওমা! নিমাই বলিস কী? আমার বউমা লক্ষ্মী, ওর অভাব কী যে, সে চুরি করে খাবে?
নিমাই :
উনি যদি লক্ষ্মীই হন মা, তাহলে তো নারায়ণের নৈবেদ্য ওঁর ভাগ আছে। যাক – নিত্যানন্দ প্রভুকে আজই নিমন্ত্রণ করে খাওয়াও, কারণ স্বপ্নে তিনি তোমার কাছে অন্নভিক্ষা করেছেন।
শচীমাতা :
হায় আমার পোড়া কপাল! ছেলেকেও নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে হয়?
নিমাই :
সন্ন্যাসীর যে আপন ঘর থাকতে নেই, মা। তাতে তিনি ধর্মভ্রষ্ট হন।
দাদা শ্রীবাস আচার্যের বাড়িতেই আছেন। ও তো আমাদের নিজেরই ঘর।
দাদা শ্রীবাস আচার্যের বাড়িতেই আছেন। ও তো আমাদের নিজেরই ঘর।
শচীমাতা :
হুঁ, মালিনী সই-এর কপাল ভালো। যাক, আমি যাই, বলে আসি পাগল ছেলেকে ওবেলা খেতে।
ঈশান :
আমি তাহলে চললাম মা আজকের মতো।
নিমাই :
কেন ঈশানদা, তুমি যাবে কেন?
ঈশান :
যাবে কেন, সে এসে তো সমস্ত ভাত ডাল বাড়িময় ছড়াবে, ন্যাংটা হয়ে নাচবে, তারপর বাকি সকড়ি নিয়ে আমার মুখে মাথায় মাখাবে। রাত্তিরে গঙ্গাচান করলে আমায় সর্দি জ্বরবিকারে ধরবে।
নিমাই :
ঈশানদা, নিত্যানন্দ প্রভু যাঁকে স্পর্শ করেন তার জ্বর বিকার চিরকালের জন্য ছেড়ে যায়। তোমার ভয় নাই।
No comments:
Write comments