দশম খণ্ড
[ দৃশ্য পূর্ববৎ ]
ধনঞ্জয় :
এই কণ্ঠহার-এর মাঝে এই অধম কণ্টক-হাড় কি আসতে পারে, মহারাজা?
রাজা :
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! এসো ধনঞ্জয় এসো! আজ আমার সভাকবির পরিপূর্ণ প্রকাশের শুভ প্রভাত। এই শুভ প্রভাতে আমি কবিকে দিয়েছি আমার কণ্ঠহার। প্রার্থনা করো, যেন আমার সভাকবির আসন হয় বিশ্ব কবি-সভার সর্বোচ্চ স্থানে।
ধনঞ্জয় :
ও-রকম প্রার্থনা আমি করব না, মহারাজ! মানুষের আসনের উচ্চতার একটা সীমা আছে, তাকে অতিক্রম করে বসলেই আমরা তাকে বলি শাখা-মৃগ। যাক। মহারাজের আজকের আনন্দটা কি সত্যিকার?
বিদ্যাপতি :
তুমি তা বুঝবে না ধনঞ্জয়। যে প্রদীপ তিলে তিলে পুড়ে বুকের স্নেহ-রসকে জ্বালিয়ে অপরকে দান করে আলো, সেই প্রদীপই জানে এই আত্মদানের – আপনাকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেওয়ার কী অপার আনন্দ!
রাজা :
ঠিক বলেছে কবি – আরতির প্রদীপ নিববার আগে যেমন করে শেষবার তার উজ্জ্বলতম শিখা মেলে দেবতার মুখ দেখে নিতে চায় – তেমনি করে আমার অন্তর-দেবতা শ্রীকৃষ্ণের মুখ দেখে নিতে চাচ্ছে আমার শ্রান্ত প্রাণ-শিখা। তুমি এমন গান শোনাতে পার কবি, যা আমার অন্তিম সময়ে শুনতে ইচ্ছা করবে?
ধনঞ্জয় :
মহারাজ! এইবার কিন্তু অরসিকের মতো কথা আরম্ভ হল এবং কাজেই আমাকে সরে পড়তে হল।
রাজা :
ধনঞ্জয়! ধনঞ্জয় চলে গেলে? আঃ বাঁচলাম! বিদ্যাপতি, আমায় একটু ধরবে? এখানে উঠে এলাম কী করে জানিনে, আর বোধ হয় এখান থেকে উঠে যেতেও পারব না!
বিদ্যাপতি :
তুমি এমন করছ কেন সখা? তোমার কি কোনো অসুখ করেছে?
রাজা :
সখা! প্রেমের বৃন্দাবন; আমরা – আমি, তুমি, লছমী, অনুরাধা – জনম জনম ধরে লীলা-সহচর-সহচরী। সেই প্রেমলোকের গান যেদিন তুমি প্রথম শুনালে, সেই দিন আমার মনে পড়ে গেল প্রেম-লোকনাথ শ্রীকৃষ্ণকে। তুমি কাকে লক্ষ করে সে গান লিখেছিলে জানিনে, কিন্তু তোমার গানের মন্ত্রে আমি উপাসনা করতে লাগলাম – রাধাশ্যামের যুগলমূর্তি। আমি আমার উপাস্য দেবতাকে পেয়েছি, তাই তাঁর বিরহ আর সহ্য করতে পারছিনে, বন্ধু! আমি আমার কানুর বাঁশরি শুনতে পেয়েছি।
বিদ্যাপতি :
রাজা!
রাজা :
(হাসিয়া) তুমি ঠকে গেলে বন্ধু! তুমি গড়লে তরণি, আর আমি তাই চুরি করে গেলাম বৈতরণি পেরিয়ে। বিদ্যাপতি! তুমি কাঁদছ? কেঁদো না সখা, তুমিও আসবে দু-দিন পরে আমাদের চির-লীলানিকেতন বৈকুণ্ঠধামে। জান বিদ্যাপতি, কাল সারারাত্রি ঘুমোইনি, আমার প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণকে ডেকেছি আর কেঁদেছি। আজ ভোরে সেই অশান্তের আহ্বান ভেসে এল কানে – ‘ওরে আয়, আমার প্রিয় আমার বুকে চলে আয়!’ রানি বলছিলেন রাজবৈদ্যকে খবর দিতে, এমন সময়ে এলে তুমি – ভবরোগের বৈদ্য। তুমি এখন গাও সখা – আমার মাধবের নাম গান –
[বিদ্যাপতির গান]
মাধব,
বহুত মিনতি করি তোয়।
দেই তুলসীতিল দেহ সমর্পলুঁ-
দয়া জনু ছোড়বি মোয়॥
গণইতে দোষ গুণ-লেশ না পাওবি
যব তুঁহু করবি বিচার,
তুঁহু জগন্নাথ জগতে কহায়সি
জগ-বাহির নহি মুই ছার॥
কিয়ে মানুষ পশু পাখি কিয়ে জনমিয়ে
অথবা কীটপতঙ্গ
করম-বিপাকে গতায়তি পুন পুন
মতি রহু তুয়া-পরসঙ্গ।
ভণয়ে বিদ্যাপতি অতিশয় কাতর
তরইতে ইহ ভবসিন্ধু –
তুয়া পদ-পল্লব করি অবলম্বন
তিল এক দেহ দীনবন্ধু॥
রাজা :
আহা, আবার বলো সখা – আবার বলো :
মাধব! তরইতে ইহ ভবসিন্ধু –
তুয়া পদপল্লব করি অবলম্বন
তিল-এক দেহ দীনবন্ধু!
আঃ আমার মাথা কার কোলে?
রানি :
রাজা! আমি দাসী – লছমী।
রাজা :
লছমী! ওঃ! কে কাঁদে আমার পায়ে পড়ে?
অনুরাধা :
রাজা! আমি, আমি – অনুরাধা। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বিষ্ণু-উপাসক, পরম প্রেমিক – তুমি, আমায় পায়ের ধুলো দিয়ে যাও, আমি ওই চরণধূলির প্রসাদে – মুক্ত হয়ে যাই!
রাজা :
অনুরাধা! আমি যে কৃষ্ণকে পেয়েছি ধ্যানে, সে কৃষ্ণকে তুমি যে রেখেছ বুকে পুরে। অনুরাধা – অনুরাধা – কী মধুর নাম! এই তো আমার বৃন্দাবন। বিদ্যাপতি, নারায়ণ, লছমী, অনুরাধা – কৃষ্ণনাম গান – এরই মাঝে যেন জন্মে জন্মে আসি – শ্রীকৃষ্ণ মাধব মা-ধ-ব...(রাজার মৃত্যু)
বিদ্যাপতি, অনুরাধা, লছমী :
রাজা! রাজা! (এক সঙ্গে চিৎকার)
No comments:
Write comments