Search This Blog

Theme images by MichaelJay. Powered by Blogger.

Blog Archive

Sunday, November 13, 2016

অগ্নিগিরি

বীররামপুর গ্রামের আলি নসিব মিয়াঁর সকল দিক দিয়েই আলি নসিব। বাড়ি, গাড়ি ও দাড়ির সমান প্রাচুর্য! ত্রিশাল থানার সমস্ত পাটের পাটোয়ারি তিনি।


বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। কাঁঠাল-কোয়ার মত টকটকে রং। আমস্তক কপালে যেন টাকা ও টাকের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র।


তাঁকে একমাত্র দুঃখ দিয়াছে – নিমকহারাম দাঁত ও চুল। প্রথমটা গেছে পড়ে, দ্বিতীয়টার কতক গেছে উঠে, আর কতক গেছে পেকে। এই বয়সে এই দুর্ভাগ্যের জন্য তাঁর আপশোশের আর অন্ত নাই। মাথার চুলগুলোর অধঃপতন রক্ষা করবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেননি ; কিন্তু কিছুতেই যখন তা রুখতে পারলেন না, তখন এই বলে সান্ত্বনা লাভ করলেন যে, সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডেরও টাক ছিল। তাঁর টাকের কথা উঠলে তিনি হেসে বলতেন যে, টাক বড়োলোকদের মাথাতেই পড়ে – কুলি-মজুরের মাথায় টাক পড়ে না! তা ছাড়া, হিসেব নিকেশ করবার জন্য নি-কেশ মাথারই প্রয়োজন বেশি। কিন্তু টাকের এত সুপারিশ করলেও তিনি মাথা থেকে সহজে টুপি নামাতে চাইতেন না। এ নিয়ে কেউ ঠাট্টা করলে তিনি বলতেন – টাক আর টাকা দুটোকেই লুকিয়ে রাখতে হয়, নইলে লোকে বড়ো নজর দেয়। টাক না হয়ে লুকোলেন, সাদা চুল-দাড়িকে তো লুকোবার আর উপায় নেই। আর উপায় থাকলেও তিনি আর তাতে রাজি নন। একবার কলপ লাগিয়ে তাঁর মুখ এত ভীষণ ফুলে গেছিল, এবং তার সাথে ডাক্তাররা এমন ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল যে, সেইদিন থেকে তিনি তৌবাতৌবা : অনুতাপ। করে কলপ লাগানো ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু, সাদা চুল-দাড়িতে তাঁর এতটুকু সৌন্দর্যহানি হয়নি। তাঁর গায়ের রং-এর সঙ্গে মিশে তাতে বরং তাঁর চেহারা আরও খোলতাই হয়েছে। এক বুক শ্বেত শ্মশ্রু – যেন শ্বেত বালুচরে শ্বেত মরালী ডানা বিছিয়ে আছে!


এঁরই বাড়িতে থেকে ত্রিশালের মাদ্রাসায় পড়ে – সবুর আখন্দ। নামেও সবুর, কাজেও সবুর! শান্তশিষ্ট গো-বেচারা মানুষটি। উনিশ-কুড়ির বেশি বয়স হবে না, গরিব শরিফশরিফ : অভিজাত। ঘরের ছেলে দেখে আলি নসিব মিয়াঁ তাকে বাড়িতে রেখে তার পড়ার সমস্ত খরচ জোগান।


ছেলেটি অতিমাত্রায় বিনয়াবনত। যাকে বলে – সাত চড়ে রা বেরোয় না। তার হাবভাব যেন সর্বদাই বলছে – ‘আই হ্যাভ দি অনার টু বি সার ইয়োর মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সারভেন্ট’।


আলি নসিব মিয়াঁর পাড়ার ছেলেগুলি অতিমাত্রায় দুরন্ত। বেচারা সবুরকে নিয়ে দিনরাত তারা প্যাঁচা খ্যাঁচরা করে। পথে ঘাটে ঘরে বাইরে তারা সবুরকে সমানে হাসি ঠাট্টা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের জল ছিঁচে উত্যক্ত করে। ছেঁচা জল আর মিছে কথা নাকি গায়ে বড়ো লাগে – কিন্তু সবুর নীরবে এ সব নির্যাতন সয়ে যায়, এক দিনের তরেও বে-সবুর হয়নি।


পাড়ার দুরন্ত ছেলের দলের সর্দার রুস্তম। সে-ই নিত্য নূতন ফন্দি বের করে সবুরকে খ্যাপানোর। ছেলে মহলে সবুরের নাম প্যাঁচা মিয়াঁ। তার কারণ, সবুর স্বভাবতঃই ভীরু নিরীহ ছেলে ; ছেলেদের দলের এই অসহ্য জ্বালাতনের ভয়ে সে পারতপক্ষে তার এঁদো কুঠরি থেকে বাইরে আসে না। বেরুলেই প্যাঁচার পিছনে যেমন করে কাক লাগে, তেমনি করে ছেলেরা লেগে যায়।


সবুর রাগে না বলে ছেলেদের দল ছেড়েও দেয় না। তাদের এই খ্যাপানোর নিত্য নূতন ফন্দি আবিষ্কার দেখে পাড়ার সকলে যে হেসে লুটিয়ে পড়ে, তাতেই তারা যথেষ্ট উৎসাহ লাভ করে।


পাড়ার ছেলেদের অধিকাংশই স্কুলের পড়ুয়া। কাজেই তারা মাদ্রাসা-পড়ুয়া ছেলেদের বোকা মনে করে। তাদের পাড়াতে কোনো মাদ্রাসার ‘তালবিলিম’ (তালেবে এলম বা ছাত্র) জায়গির থাকত না পাড়ার ছেলেগুলির ভয়ে। সবুরের অসীম ধৈর্য! সে এমনি করে তিনটি বছর কাটিয়ে দিয়েছে। আর একটা বছর কাটিয়ে দিলেই তার মাদ্রাসার পড়া শেষ হয়ে যায়।


সবুর বেরোলেই ছেলেরা আরম্ভ করে – ‘প্যাঁচারে, তুমি ডাহ! হুই প্যাঁচা মিয়াঁগো, একডিবার খ্যাচখ্যাচাও গো!’ রুস্তম রুস্তমি কন্ঠে গান ধরে –


ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায় –


যাইতে যাইতে খ্যাচখ্যাচায়।


কাওয়ারা সব লইল পাছ,


প্যাঁচা গিয়া উঠল গাছ।


প্যাঁচার ভাইশতা কোলা ব্যাং


কইল চাচা দাও মোর ঠ্যাং।


প্যাঁচা কয়, বাপ বারিত যাও,


পাস লইছে সব হাপের ছাও


ইঁদুর জবাই কইর‍্যা খায়,


বোচা নাকে ফ্যাচফ্যাচায়।


  


ছেলেরা হেসে লুটিয়ে পড়ে। বেচারা সবুর তাড়াতাড়ি তার কুঠরিতে ঢুকে দোর লাগিয়ে দেয়। বাইরে থেকে বেড়ার ফাঁকে মুখ রেখে রুস্তম গায় –


প্যাঁচা, একবার খ্যাচখ্যাচাও


গর্ত থাইক্যা ফুচকি দাও।


মুচকি হাইস্যা কও কথা


প্যাঁচারে মোর খাও মাথা!


  


সবুর কথা কয় না। নীরবে বই নিয়ে পড়তে বসে। যেন কিছুই হয়নি। রুস্তমি দলও নাছোড়বান্দা। আবার গায় –


মেকুরের ছাও মক্কা যায়,


প্যাঁচায় পড়ে, দেইখ্যা আয়।


  


হঠাৎ আলি নসিব মিয়াঁকে দেখে ছেলের দল পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। আলি নসিব মিয়াঁ রসিক লোক। তিনি ছেলেদের হাত থেকে সবুরকে বাঁচালেও না হেসে থাকতে পারলেন না। হাসতে হাসতে বাড়ি ঢুকে দেখেন তাঁর একমাত্র সন্তান নূরজাহান কাঁদতে কাঁদতে তার মায়ের কাছে নালিশ করছে – কেন পাড়ার ছেলেরা রোজ রোজ সবুরকে অমন করে জ্বালিয়ে মারবে? তাদের কেউ তো সবুরকে খেতে দেয় না!


তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে রুস্তমিদল গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিল –


প্যাঁচা মিয়াঁ কেতাব পড়ে


হাঁড়ি নড়ে দাড়ি নড়ে!


নূরজাহান রাগে তার বাবার দিকে ফিরেও তাকাল না। তার যত রাগ পড়ল গিয়ে তার বাবার উপরে। তার বাবা তো ইচ্ছা করলেই ওদের ধমকে দিতে পারেন। বেচারা সবুর গরিব, স্কুলে পড়ে না, মাদ্রাসায় পড়ে – এই তো তার অপরাধ। মাদ্রাসায় না পড়ে সে যদি খানায় পড়ত ডোবায় পড়ত – তাতেই বা কার কী ক্ষতি হত। কেন ওরা আদা-জল খেয়ে ওর পিছনে এমন করে লাগবে?


আলি নসিব মিয়াঁ সব বুঝলেন। কিন্তু বুঝেও তিনি কিছুতেই হাসি চাপতে পারলেন না। হেসে ফেলে মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন, ‘কি হইছেরে বেডি? ছেমরাডা প্যাঁচার লাহান বাড়িতে বইয়্যা রইব, একডা কতা কইব না, তাইনাসেন উয়ারে প্যাঁচা কয়।’ নূরজাহান রেগে উত্তর দিল, ‘আপনি আর কইবেন না, আব্বা, হে বেডায় ঘরে বইয়া কাঁদে আর আপনি হাসেন! আমি পোলা অইলে এইদুন একচটকনা দিতাম রুস্তম্যারে আর উই ইবলিশা পোলাপানেরে, যে, ওই হ্যানে পাইর‍্যা যাইত উৎকা মাইর‍্যা। উইঠ্যা আর দানাপানি খাইবার অইত না!’ বলেই কেঁদে ফেললে।


আলি নসিব মিয়াঁ মেয়ের মাথায় পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘চুপ দে বেডি, এইবারে ইবলিশের পোলারা আইলে দাবার পইর‍্যা লইয়া যাইব! মুনশি বেডারে কইয়্যা দিবাম, হে ওই রুস্তম্যারে ধইরা তার কান দুডা এক্কেরে মুতা কইর‍্যা কাইট্যা হালাইবো!’


নূরজাহান অত্যন্ত খুশি হয়ে উঠল।


সে তাড়াতাড়ি উঠে বলল, ‘আব্বাজান, চা খাইবেন নি?’


আলি নসিব মিয়াঁ হেসে ফেলে বললেন, ‘বেডির বুঝি য়্যাহন চায়ের কথা মনে পল।’


নূরজাহান আলি নসিব মিয়াঁর একমাত্র সন্তান বলে অতিমাত্রায় আদুরে মেয়ে। বয়স পনেরো পেরিয়ে গেছে। অথচ বিয়ে দেবার নাম নেই বাপ-মায়ের। কথা উঠলে বলেন, মনের মতো জামাই না পেলে বিয়ে দেওয়া যায় কী করে! মেয়েকে তো হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দেওয়া যায় না! আসল কথা তা নয়। নূরজাহানের বাপ-মা ভাবতেই পারেন না, ওঁদের ঘরের আলো নূরজাহান অন্য ঘরে চলে গেলে তাঁরা এই আঁধার পুরীতে থাকবেন কী করে! নইলে এত ঐশ্বর্যের একমাত্র উত্তরাধিকারিণীর বরের অভাব হয় না। সন্বন্ধও যে আসে না, এমন নয় ; কিন্তু আলি নসিব মিয়াঁ এমন উদাসীনভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলেন যে, তারা আর বেশি দূর না এগিয়ে সরে পড়ে।


নূরজাহান বাড়িতে থেকে সামান্য লেখাপড়া শিখেছে। এখন সবুরের কাছে উর্দু পড়ে। শরিফ ঘরের এত বড়ো মেয়েকে অনাত্মীয় যুবকের কাছে পড়তে দেওয়া দূরের কথা, কাছেই আসতে দেয় না বাপ মা ; কিন্তু এদিক দিয়ে সবুরের এতই সুনাম ছিল যে, সে নূরজাহানকে পড়ায় জেনেও কোনো লোক এতটুকু কথা উত্থাপন করেনি।


সবুর যতক্ষণ নূরজাহানকে পড়ায় ততক্ষণ একভাবে ঘাড় হেঁট করে বসে থাকে, একটিবারও নূরজাহানের মুখের দিকে ফিরে তাকায় না। বাড়ি ঢোকে মাথা নিচু করে, বেরিয়ে যায় মাথা নিচু করে! নূরজাহান, তার বাবা মা সকলে প্রথম প্রথম হাসত – এখন সয়ে গেছে!


সত্যসত্যই, এই তিন বছর সবুর এই বাড়িতে আছে, এর মধ্যে সে একদিনের জন্যও নূরজাহানের হাত আর পা ছাড়া মুখ দেখেনি।


এ নূরজাহান জাহানের জ্যোতি না হলেও বীররামপুরের জ্যোতি – জোহরাজোহরা : অপরূপ সুন্দরী, মর্ত্যে আল্লাহ্‌ প্রেরিত হারুত ও মারুত তার প্রেমে পড়ে ন্যায় অন্যায় সব ভুলে গেছিল।
সেতারাসেতারা : সুন্দরীশ্রেষ্ঠ।, এ সম্বন্ধে কারও মতদ্বৈধ নাই। নূরজাহানের নিজেরও যথেষ্ট গর্ব আছে, মনে মনে তার রূপের সম্বন্ধে।


আগে হত না – এখন কিন্তু নূরজাহানের সে অহংকারে আঘাত লাগে – দুঃখ হয় এই ভেবে যে, তার রূপের কি তা হলে কোনো আকর্ষণই নেই? আজ তিন বছর সে সবুরের কাছে পড়ছে – এত কাছে তবু সে একদিন মুখ তুলে তাকে দেখল না? সবুর তাকে ভালোবাসুক – এমন কথা সে ভাবতেই পারে না, – কিন্তু ভালো না বাসলেও যার রূপের খ্যাতি এ অঞ্চলে – যাকে একটু দেখতে পেলে অন্য যে কোনো যুবক জন্মের জন্য ধন্য হয়ে যায় – তাকে একটিবার একটুক্ষণের জন্যেও চেয়েও দেখল না! তার সতীত্ব কি নারীর সতীত্বের চেয়েও ঠুনকো?


ভাবতে ভাবতে সবুরের উপর তার আক্রোশ বেড়ে ওঠে, মন বিষিয়ে যায়, ভাবে আর তার কাছে পড়বে না! কিন্তু যখন দেখে – নির্দোষ নির্বিরোধ নিরীহ সবুরের উপর রুস্তমি দল ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে, তখন আর থাকতে পারে না। আহা, বেচারার হয়ে কথা কইবার যে কেউ নেই! সে নিজেও যে একটিবার মুখ ফুটে প্রতিবাদ করে না। এ কী পুরুষ মানুষ বাবা! মার, কাট, মুখ দিয়ে কথাটি নেই! এমন মানুষও থাকে দুনিয়াতে!


যত সে এইসব কথা ভাবতে থাকে, তত এই অসহায় মানুষটির ওপর করুণায় নূরজাহানের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে!


সবুর পুরুষ বলতে যে মর্দ-মিনসে বোঝায় – তা তো নয়ই, সুপুরুষও নয়। শ্যামবর্ণ একহারা চেহারা। রূপের মধ্যে তার চোখ দুটি। যেন দুটি ভীরু পাখি। একবার চেয়েই অমনি নত হয়। সে চোখ, তার চাউনি – যেমন ভীরু, তেমনই করুণ, তেমনই অপূর্ব। পুরুষের অত বড়ো অত সুন্দর চোখ সহজে চোখে পড়ে না।


এই তিন বছর সে এই বাড়িতে আছে, কিন্তু কেউ ডেকে জিজ্ঞাসা না করলে – সে অন্য লোক তো দূরের কথা – এই বাড়িরই কারুর সাথে কথা কয়নি। নামাজ পড়ে, কোরান তেলাওততেলাওত : ধর্মগ্রন্থ পাঠ। করে, মাদ্রাসা যায়, আসে, পড়ে কিংবা ঘুমোয় – এই তার কাজ। কোনোদিন যদি ভুলক্রমে ভিতর থেকে খাবার না আসে, সে না খেয়েই মাদ্রাসা চলে যায় – চেয়ে খায় না। পেট না ভরলেও দ্বিতীয়বার খাবার চেয়ে নেয় না। তেষ্টা পেলে পুকুরঘাটে গিয়ে জল খেয়ে আসে, বাড়ির লোকের কাছে চায় না।


সবুর এত অসহায় বলেই নূরজাহানের অন্তরের সমস্ত মমতা সমস্ত করুণা ওকে সদাসর্বদা ঘিরে থাকে। সে না থাকলে, বোধ হয় সবুরের খাওয়াই হত না সময়ে। কিন্তু নূরজাহানের এত যে যত্ন, এত যে মমতা এর বিনিময়ে সবুর এতটুকু কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টি দিয়েও তাকে দেখেনি, কিছু বলা তো দূরের কথা। মারলে – কাটলেও অভিযোগ করে না, সোনা-দানা দিলেও কথা কয় না!

No comments:
Write comments

Interested for our works and services?
Get more of our update !