Search This Blog

Theme images by MichaelJay. Powered by Blogger.

Blog Archive

Sunday, November 27, 2016

কৈশোর

কৈশোর


বিশ্ব-মনের সোনার স্বপনে কিশোর তনু বেড়ায় ওই


তন্দ্রা ঘোরে অন্ধ আঁখি নিখিল খোঁজে কই সে কই।


বাজিয়ে বাঁশি চড়ায় উট,


নিরুদ্দেশে দেয় সে ছুট,


‘হেরার’হেরার : মক্কার অদূরে অবস্থিত পাহাড় বিশেষ, যার গুহায় হজরত মোহাম্মদ সিদ্ধিলাভ করেন। গুহায় লুকিয়ে ভাবে – এ আমি তো আমি নই!


অতল জলে বিম্বসম ফুটেই কেন বিলীন হই।


রূপ ধরে ওই বেড়ায় খেলে দাহন-বিহীন অগ্নিশিখ


পথিক ভোলে পথ-চলা তার, দাঁড়িয়ে দেখে নির্নিমিখ।


সাগর অতল ডাগর চোখ


ভোলায় আকাশ অলখ লোক,


যায় যে পথে – ফিনকি রূপের ছড়িয়ে পড়ে দিগ্‌বিদিক,


আরব-সাগর-মন্থন-ধন আরব দুলাল নীল মানিক।


পালিয়ে বেড়ায় পলাতকা রাখতে নারে আপন জন,


কারুর পানে চায় না ফিরে কে জানে তার কোথায় মন।


আদর করে সবাই চায়,


সে চলে যায় চপল পায়,


কে যেন তার বন্ধু আছে ডাকছে তারে অনুক্ষণ,


তার সে ডাকের ইঙ্গিত ওই সাগর মরু পাহাড় বন।


মক্কাপুরীর রত্নমালায় মধ্যমণি এই কিশোর,


পিক পাপিয়া অনেক আছে – দূরবিহারী এ চকোর।


কী মায়া যে এ জানে,


অজানিতে মন টানে,


সবার চোখে নিথর নিশা, উহার চোখে প্রভাত ঘোর।


ফটিক জলের ঊষর দেশে সে এসেছে বাদল-মৌর।


এমনি করে দ্বাদশ বরষ একার জীবন যায় কাটি,


আবুতালেবআবুতালেব : হজরত মোহাম্মদের চাচা ও অভিভাবক। বলল, “এবার করব সোনা এই মাটি!


আহ্‌মদ তোর দৌলতে!


এবার যাব দূর পথে


বাণিজ্যে ‘শাম’শাম : উত্তর আরবের অন্তর্গত সিরিয়া। ‘মোকাদ্দসে’মোকাদ্দস : আবর্জনামুক্ত বা পবিত্র।, তুই যেন বাপ রোস খাঁটি,


দেখিস তুই এ তোর পিতাম-পিতার পূত এই ঘাঁটি।”


‘চাচা, তোমার সঙ্গে যাব’, বলল কিশোর শেষ নবি,


চক্ষে তাহার উঠল জ্বলে ভবিষ্যতের কোন ছবি।


কে যেন দূর পথের পার


ডাকছে তারে বারংবার,


সন্ধানে তার পার হবে সে এই সাহারা এই গোবি,


আকাশ তারে ডাক দিয়েছে আর কি বাঁধা রয় রবি?


বুঝায় যত আবুতালেব, “মানিক, সে যে অনেক দূর!


দজলাদজলা : টাইগ্রিস নদী। ফোরাতফোরাত : ইউফ্রেটিস নদী। পার হতে হয়, লঙ্ঘিতে হয় পাহাড় তূরতূর : যে পাহাড়ে মুসা আল্লাহ্‌র দর্শন লাভ করেন।


মরুর ভীষন ‘লু’ হাওয়া,


যায় না সেথা জল পাওয়া,


কত সে পথ যাব মোরা, ঘুরতে হবে অনেক ঘুর!”


কিশোর চোখে ভেসে ওঠে কোকাফ মুলুকমুলুক : দুর্গম পর্বত যেখানে পরিরা বাস করে। পরির পুর।


লঙ্ঘি সবার নিষেধ-বাধা চাচার সাথে কিশোর যায়


বাণিজ্যে দূর দেশে প্রথম উটের পিঠে – মরুর নায়।


দেখবি রে আয় বিশ্বজন,


রত্ন খোঁজে যায় রতন!


ধুলায় করে সোনামানিক যেজন ঈষৎ পা-র ছোঁয়ায়,


আনতে সোনা সে যায় রে ওই সোনার রেণু ছিটিয়ে পায়!


দেখবি কে আয়, দরিয়া চলে নহরনহর : স্রোতস্বিনী। থেকে আনতে জল,


আনতে পাথর চলল পাহাড় ঝরনা-পথে সচঞ্চল।


ফুলের খোঁজে কানন যায়,


নতুন খেলা দেখবি আয়!


বেহেশ্‌ত-দ্বারী রেজওয়ানরেজওয়ান : স্বর্গের দ্বাররক্ষক। চায় কোথায় পাবে মিষ্ট ফল!


সূর্য চলে আলোর খোঁজে, মানিক খোঁজে সাগর-তল!


দেখবি কে আয়, আজ আমাদের নওল কিশোর সওদাগর


শুক্লা দ্বাদশ তিথির চাঁদের কিরণ ঝলে মুখের পর


আয় মহাজন ভাগ্যবান,


এই সদাগর এই দোকান


আর পাবিনে, আর পাবিনে এমন বিকিকিনির দর!


আয় গুনাগারগুনাগার : পাপী।, এবার সেরা সওদাগরের চরণ ধর!


আয় গুনাগার, লাভ লোকসান খতিয়ে নে তোর এই বেলা,


আসবে না আর এমন বণিক, বসবে না আর এই মেলা!


ফিরদৌসের এই বণিক


মাটির দরে দেয় মানিক!


জহর নিয়ে জহরত দেয়, নও-বণিকের নও-খেলা।


আয় গুনাগার, ক্ষতির হিসাব চুকিয়ে নে তোর এই বেলা।


গুনাগারীর জীবন-খাতায় শূন্য যাদের লাভের ঘর,


এই বেলা আয় – ভুলিয়ে নে সব, কিশোর বয়েস সওদাগর।


আন রে জাহাজ, আন রে উট,


বিশ হাতে আজ মানিক লুট!


অর্থ খুঁজে ব্যর্থ যে জন, এর কাছে খোঁজ তার খবর।


শূন্য ঝুলি দেউলিয়া আয়, পুণ্যে ঝুলি বোঝাই কর!


আপনপ্রেয় শ্রেয় যা সব মৃত্যুরে তা দান করে


অপরিমাণ জীবন-পুঁজি সে এনেছে অন্তরে,


তাই দিবে সে বিলিয়ে আজ


সকলজনে বিশ্বমাঝ!


আয় দেনাদার, বিনা সুদে ঋণ দেবে এ প্রাণ ভরে,


ঋণ-দায়ে যে পালিয়ে বেড়ায়, শোধ দেবে এ, আন ধরে!...


পঙ্খিরাজে পাল্লা দিয়ে মরুর পথে ছুটছে উট


চরণ তার আজ বারণ-হারা, রুখতে নারে বলগা-মুঠ।


পৃষ্ঠে তাহার এ কোনজন,


চলতে শুধু চায় চরণ


‘হজজ্‌’হজজ্‌ : আরবি কবিতার ছন্দ বিশেষ। ‘রমল্’রমল্ : আরবি কবিতার ছন্দ বিশেষ। ছন্দ-দোলে দুলিয়ে তনু সে দেয় ছুট।


উট নয় সে, ফিরদৌসের বোররাকবোররাক : পক্ষিরাজ। – নয় নয় এ ঝুট!


চলতে পথে মনে ভাবে যতেক আরব বণিক দল –


ঊষর মরুর ধূসর রোদেও কেমনে তনু রয় শীতল!


মেঘ চাইতে পায় পানি,


এ কোন মায়ার আমদানি!


খুঁড়তে মরু ঠাণ্ডা পানি উথলে আসে অনর্গল।


উড়ছে সাথে সফেদ কপোত ঝাঁক বেঁধে ওই গগনতল।


বুঝতে নারে, ভাবে এসব খোদার খেলা, নাই মানে!


মরুর রবি নিষ্প্রভ কি হল এবার, কে জানে!


ছিটায় না সে আগুন-খই,


সে ‘লু’ হাওয়ায় ঘূর্ণি কই,


থাকত না তো এমন ডাঁসা আঙুর মরুর উদ্যানে।


জাদুকরের জাদু এসব – মরুর পথে সবখানে।


পৌঁছাল শেষ দূর বোসরায়বোসরায় : ইরাকের শহর, গোলাপবাগানের জন্য বিখ্যাত। তালিব, আরব সওদাগর


নগরবাসী আসল ছুটে, দেখবে জিনিস নতুনতর।


বণিকদলে ও কোনজন –


চক্ষে নিবিড় নীলাঞ্জন,


এই বয়সে কে এল ওই শূন্য করে কোন সে ঘর!


কার আঁচলের মানিক লুটায় মরুর ধুলায় পথের পর।


অপরূপ এক রূপের কিশোর এসেছে ‘শাম’, উঠল রোল,


মুখর যেমন হয় গো বিহগ আসলে রবি গগন-কোল।


পালিয়ে হুরিস্থান সুদূর


এসেছে এ কিশোর হুর,


নওরোজের আজ বসল মেলা, রূপের বাজার ডামাডোল!


আকাশ জুড়ে সজল মেঘের কাজল নিশান দেয় গো দোল।


রূপ দেখেছে অনেক তারা, এ রূপ যেন অলৌকিক,


এ রূপ-মায়া ঘনিয়ে আসে নয়ন ছেড়ে মনের দিক!


আসল পুরোহিতের দল,


দৃষ্টি তাদের অচঞ্চল


‘মোহন’ ধ্যানে দেখলে যারে, রূপ ধরে কি সেই মানিক


আসল মানব-ত্রাণের তরে কিশোর ছেলে এই বণিক?


কবুতরায় কূজনগীতি গাইছে কবুতরের ঝাঁক,


দুম্বা-শিশু মা ভুলে তার উহার মুখে চায় অ-বাক।


গগন-বিথার কাজল মেঘ,


ফুল-ফোটানো পবন-বেগ,


মনের বনে শহদশহদ : পুষ্পমধু। ঝরে আপনি ফেটে মধুর চাক,


মুঞ্জরিল পুষ্পে পাতায় মলিন লতা তরুর শাখ।


সেথায় ছিল ইশাইইশাই : খ্রীষ্টীয়।-পুরুত ‘বোহায়রা’বোহায়রা : একজন খ্রিস্টীয় যাজক। নাম, ধ্যান-মগন,


ইশাই-দেউল মাঝে বসে উথলে ওঠে নয়ন মন!


বসল ধ্যানে পুনর্বার,


আগমনি আজকে কার।


দেখলে ধ্যানে – সকল নবি ঈশা, মুসা, দাউদ, যন,


আসার খবর কইল যাহার আজ এসেছে সেই রতন!


দেখল – তারে বিলিয়ে ছায়া কাজল নীরদ ফিরছে সাথ,


লুটিয়ে পড়ে মূর্তিপূজার দেউল টুটে, ‘লাত মানাত’লাত মানাত : ইসলাম পূর্ব যুগে আরবদের দ্বারা পূজিত দেবতা।


অগ্নি পূজার দেউল সব


যায় নিভে গো, করে স্তব,


তরুর ছায়া সরে আসে বাঁচাতে গো রোদের তাত।


জন্তু জড় কইছে ‘সালাত’সালাত : নামাজ।, নতুন ‘দীনের’দীনের : জাদু। ‘তেলেসমাত’তেলেসমাত : ইসলামের।


সে এসেছে বণিক বেশে এই সিরিয়ার এই নগর,


ধ্যান ফেলে সে আসল ছুটে, যথায় আরব-সওদাগর।


উদ্দেশ যার পায় না মন


হাতের কাছে আজ সে জন,


‘বোহায়রা’ চায় পলক-হারা, লুটাতে চায় ধুলার পর।


গগন ফেলে ধরায় এল আজকে ধ্যানের চাঁদ অ-ধর।


কিশোর নবির দস্তদস্ত : হাত। চুমি ‘বোহায়রা’ কয়, “এই তো সেই –


শেষের নবি – বিশ্ব নিখিল ঘুরছে যাঁহার উদ্দেশেই।


আল্লার এই শেষ ‘রসুল’রসুল : মানুষকে সত্যের পথ প্রদর্শন করার জন্যে আল্লাহ্ প্রেরিত মহাপুরুষ।,


পাপের ধরায় পুণ্যফুল,


দীন-দুনিয়ার সর্দার এই, ইহার আদি অন্ত নেই।


আল্লার এ রহমত রূপ, নিখিল খুঁজে পায় না যেই।”


বোহায়রা কয়, ‘আমার মাঠ রইল দাত্ততদাত্তত : নিমন্ত্রণ। আজ সবার।’


মুগ্ধ-চিতে শুনল তালিব সকল কথা বোহায়রার।


হাসল শুনে কোরেশগণকোরেশগণ : হজরত মহম্মদ মক্কর যে উপজাতির অন্তর্গত ছিলেন।,


বলল, ‘ফজুলফজুল : অতিরঞ্জন। ওর বচন!’


শুধায় তবু, ‘কেমন করে তুমিই পেলে খবর তার?’


বোহায়রা কয় হেসে, ‘যেমন দীপের নীচেই অন্ধকার।


দেখছি আমি ক-দিন থেকেই ধ্যানের চোখে অসম্ভব


অনেক কিছু – পাহাড় নদী কাহার যেন করে স্তব,


প্রতি তরু পাষাণ জড়


এই কিশোরের চরণ পর


পড়েছে ঝুঁকে অধোমুখে সিজদাসিজদা : আভূমি প্রণিপাত। করার লাগি সব।


সেদিন হতে শুনছি কেবল নতুনতর ‘সালাত’সালাত : নামাজ।-রব।


‘দেখেছি এর পিঠের পরে নবুয়তেরনবুয়ত : নবির পদ। মোহর সিল,


চক্ষে ইহার পলক-বিহীন দৃষ্টি গভীর নিতল নীল।


নবি ছাড়া কারেও গড়


করে নাকো পাষাণ জড়!


‘নজ্জুম’নজ্জুম : জ্যোতিষী। সব বলছে সবাই, আসবে সে জন এ মঞ্জিল


এই সে মাসে, আমার ধ্যানে তাদের গোনায় আছে মিল।


রুমীয়গণ দেখলে এরে হয়তো প্রাণে করবে বধ,


দিনের আলোয় আর এনো না, আবুতালিবআবুতালিব : হজরতের চাচা ও পিতার মৃত্যু পর হজরতের অভিভাবক।, এ সম্পদ।


এই যে কিশোর সুলক্ষণ –


দেখলে ইহার শত্রুগণ –


ফেলবে চিনে, মারবে প্রাণে, খোদার কালামকালাম : বাণী, হুকুম। করবে রদ!’


তালিব শুনে কাঁপল ভয়ে, হাসল শুনে মোহাম্মদ।


এমন সময় আসল সেথা সপ্ত রোমান অস্ত্র-কর,


বোহায়রা কয়, ‘কাহার খোঁজে এসেছ এই যাজক-ঘর?’


বলল তারা, ‘খুঁজছি তায়


শেষের নবির আসন চায়


যে জন – তারে, বেরিয়েছে সে এই মাসে এই পথের পর!’


বোহায়রা কয়, ‘বণিক এরা, ইহারা নয়, নবির চর!’


ফিরে গেল রোমান ইহুদ, বোহায়রা কয়, ‘আজ রাতে


পাঠিয়ে দাও এ কিশোর কুমার তোমার স্বদেশ মক্কাতে!’


কিশোর নবি সওদাগর


চলল ফিরে আবার ঘর,


বেলালবেলাল : ইসলামের নামাজ যিনি প্রথম পড়েছিলেন।, আবুবকরআবুবকর : হজরতের প্রথম শিষ্য। চলে সঙ্গী হয়ে সেই সাথে।


জীবন-পথের চির-সাথি সাথি হল আজ প্রাতে।

No comments:
Write comments

Interested for our works and services?
Get more of our update !