রাত্রে আরিফের কীসের শব্দে ঘুম ভাঙিয়া গেল। সে চক্ষু মেলিতেই দেখিল, তাহার শিয়রে একজন কে উন্মুক্ত তরবারি হস্তে দাঁড়াইয়া এবং পার্শ্বেই কামরায় আর একজন লোক, বোধ হয় স্ত্রীলোক জোহরার বাক্স ভাঙিয়া তাহার অলংকার অপহরণ করিতেছে! ভয়ে সে মৃতবৎ পড়িয়া রহিল; তাহার চিৎকার করিবার ক্ষমতা পর্যন্ত কে যেন অপহরণ করিয়া লইয়াছে!
কিন্তু ভয় পাইলেও তাহার মনে কেমন সন্দেহ হইল। স্ত্রীলোক ডাকাত! সে ঈষৎ চক্ষু খুলিয়া তাহাকে চিনিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু বাহিরে এমন ভান করিয়া পড়িয়া থাকিল, যেন সে অঘোরে ঘুমাইতেছে।
যে ঘরে সে ও জোহরা শয়ন করিয়াছিল, তাহার পার্শ্বে আর একটি কামরা – স্বল্পায়তন। সেই কামরায় একটা স্টিলের ট্রাংকে জোহরার গহনাপত্র থাকিত। প্রায় বিশ হাজার টাকার গহনা!
জোহরা বহু অনুনয় করিয়া আরিফকে ওই গহনাপত্র রসুলপুরে রাখিয়া আসিবার জন্য বহুবার বলিয়াছে, আরিফ সে কথায় কর্ণপাত করে নাই। সে বলিত, ‘তোমার কপালেই আজ আমাদের ওই অর্থ অলংকার, ও কয়টা টাকার অলংকার যদি চুরি যায় যাক, তোমাকে তো চুরি করতে পারবে না। ও তোমার জিনিষ তোমার কাছে থাক। আর তা ছাড়া তোমার বাবা এ অঞ্চলের পির, ওঁর ঘরে কেউ চুরি করতে সাহস করবে না।’
আরিফ নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস করিতে পারিল না, যখন দেখিল, ওই মেয়ে ডাকাত আর কেউ নয় সে তাহার শাশুড়ি – জোহরার মাতা!
দু-দিন আগের ঝড়ে ঘরের কতকগুলো খড় উড়িয়া গিয়াছিল এবং সেই অবকাশ পথে শুক্লা দ্বাদশীর চন্দ্র-কিরণ ঘরের ভিতর আসিয়া পড়িয়াছিল। শাশুড়ি সমস্ত অলংকারগুলি পোঁটলায় বাঁধিয়া চলিয়া আসিবার জন্য মুখ ফিরাইতেই তাহার মুখে চন্দ্রের কিরণ পড়িল এবং সেই আলোকে আরিফ যাহার মুখ দেখিল, তাহাকে সে মাতার অপেক্ষাও ভক্তি করে। তাহার মুখে চোখে মনে অমাবস্যার অন্ধকার ঘনাইয়া আসিল।
এত কুৎসিত এ পৃথিবী!
সে আর উচ্চবাচ্য করিল না। প্রাণপণে নিজেকে সংযত করিয়া রাখিল। সে দেখিল, তাহার শাশুড়ির পিছু পিছু তরবারিধারী ডাকাতও বাহির হইয়া গেল। তাহারা উঠানে আসিয়া নামিতেই সে উঠিয়া বাতায়ন-পথে দেখিতে পাইল ওই ডাকাতও আর কেহ নয় – তাহারই শ্বশুর।
আরিফ জানিত, কিছুদিন ধরিয়া তাহার শ্বশুরের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হইয়া পড়িয়াছিল। দেশেও প্রায় দুর্ভিক্ষ উপস্থিত। মাঝে মাঝে তাহার শ্বশুর ঘটি বাটি বাঁধা দিয়া অন্নের সংস্থান করিতেছিলেন, ইহারাও সে অভাস পাইয়াছিল। ইহা বুঝিয়াই সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া অর্থ সাহায্য করিতে চাহিয়াছিল, কিন্তু তাহার শ্বশুর তাহা গ্রহণ করিতে স্বীকৃত হন নাই। জোহরার হাতে দিয়াও সে দেখিয়াছে, তাঁহারা জামাতার নিকট হইতে অর্থ সাহায্য লইতে নারাজ।
হীনস্বাস্থ্য জোহরা অঘোরে ঘুমাইতেছিল, আরিফ তাহাকে জাগাইল না। ভয়ে, ঘৃণায়, ক্রোধে তাহার আর ঘুম হইল না।
সকালের দিকে একটু ঘুমাইতেই কাহার ক্রন্দনে সে জাগিয়া উঠিল। তাহার শাশুড়ি তখন চিৎকার করিয়া কাঁদিতেছে, চোরে তাহাদের সর্বনাশ করিয়াছে।
জোহরাও তাড়াতাড়ি জাগিয়া উঠিয়া বিস্ময়বিমূঢ়ার মতো চাহিয়া রহিল।
আরিফের আর সহ্য হইল না। দিনের আলোকের সাথে সাথে তাহার ভয়ও কাটিয়া গিয়াছিল।
সে বাহিরে আসিয়া চিৎকার করিয়া বলিল, ‘আর কাঁদবেন না মা, ও অলংকার যে চুরি করেছে তা আমি জানি, আমি ইচ্ছা করলে এখনই তাদের ধরিয়ে দিতে পারি।’
বলাবাহুল্য, এক মুহূর্তে শাশুড়ির ক্রন্দন থামিয়া গেল! শ্বশুর-শাশুড়ি দুই জন পরস্পরে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করিতে লাগিল।
আরিফ বাহিরে চলিয়া যাইতেছিল, হঠাৎ শ্বশুর জামাতার হাত ধরিয়া বলিল, ‘কে বাবা সে চোর? দেখেছ? সত্যিই দেখেছ তাকে?’
আরিফ অবজ্ঞার হাসি হাসিয়া বলিল, ‘জি হাঁ দেখেছি! কলিকাল কিনা, তাই সব কিছু উলটে গেছে। যার চুরি গেছে, তারই চোরের হাত চেপে ধরার কথা, এখন কিন্তু চোরই যার চুরি গেছে তার হাত চেপে ধরে!’
শ্বশুর যেন আহত হইয়া হাত ছাড়িয়া দিল।
আরিফ জোহরাকে ডাকিয়া রাত্রির সমস্ত ব্যাপার বলিল ও ইঙ্গিতে ইহাও জানাইল যে হয়তো এ ব্যাপারে তাহারও হাত আছে।
জোহরা মূর্ছিতা হইয়া পড়িয়া গেল।তাহার মূর্ছা ভাঙিবার পর আরিফ বলিল, ‘সে এখনই এ বাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে! এ নরক-পুরীতে সে আর এক মুহূর্তও থাকিবে না।’
শ্বশুর-শাশুড়ি যেন পাথর হইয়া গিয়াছিল; এমনকী জোহরার মূর্ছাও আরিফই ভাঙাইল, পিতা-মাতা কেহ আসিয়া সাহায্য করিল না।
আরিফ চলিয়া যাইবার উদ্যোগ করিতেই জোহরা তাহার পায়ে লুটাইয়া বলিল, ‘আমাকে নিয়ে যাও, আমাকে এখানে রেখে যেয়ো না। খোদা জানেন, এই তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, আমি কোনো অপরাধ করিনি।’
আরিফ জোহরার কান্নাকাটিতে রাজি হইল তাহাকে কলিকাতা লইয়া যাইতে।
স্বামীর নির্দেশ মতো জোহরা পিতা-মাতাকে আর কিছুই প্রশ্ন করিল না।
No comments:
Write comments