সেইদিন সন্ধ্যা-রাত্রিতে বাড়ির একজন দাসী চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘ও মা গো, ভূতে ধরলে গো! জিনের বাদশা গো! জিন ভূত!’
বলিয়াই সে প্রায় অজ্ঞান হইয়া পড়িল। বাড়িময় ভীষণ হই চই পড়িয়া গেল।
আরিফের মাতা তখন আরিফকে ডাকিয়া বলিতেছিলেন, ‘হাঁ রে, বউমা যে আবার পোয়াতি, তা তো বলিসনি। ওর যে ব্যথা উঠেছে।’
আরিফ বলিতেছিল, ‘কিন্তু এখন তো ব্যথা ওঠার কথা নয় মা, মোটে তো সাত মাস!’
এমন সময় বাড়িময় শোরগোল উঠিল, ‘ভূত! ভূত! য়্যাদ্দাড়িওয়ালা ভূত!’
বাড়ির চাকর-চাকরানি সকলে বলিল, তাহারা স্বচক্ষে দেখিয়াছে – জ্যান্ত ভূত! আকাশে গিয়া তাহার মাথা ঠেকিয়াছে! বাড়ির মধ্যে আমগাছ-তলায় দাঁড়াইয়া আছে!
আরিফ, আরিফের মাতা লন্ঠন লইয়া বাহির হইয়া আসিলেন। সত্যই তো কে যেন গাছতলায় প্রেতমূর্তির মতো দাঁড়াইয়া!
তাঁহাদের পিছনে পিছনে যে ভূত দেখিতে জোহরাও বাহির হইয়া আসিয়াছিল, তাহা কেহ দেখে নাই।
হঠাৎ ভূত চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘ওরে বাপরে, সাপে খেলে রে!’
জোহরা চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘বাবা তুমি।’ আরিফের মাতাও বলিয়া উঠিল, ‘য়্যাঁ বেয়াই?’
জোহরা তখন চিৎকার করিতেছে, ‘ও সত্যই ভূত।বাবা নয়, বাবা নয়, ও ভূত! ওকে মারো! মেরে বের করে দাও!’
হঠাৎ শুনিতে পাইল, ভূত যেন যষ্টি দ্বারা নির্দয়ভাবে কাহাকে প্রহার করিতে করিতে চিৎকার করিতেছে – ‘ওরে বাপরে সাপে খেয়ে ফেললে! আমায় সাপে খেয়ে ফেলল!’
জোহরা উন্মাদিনীর মতো তাহার শাশুড়ির লন্ঠন কাড়িয়া লইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটিল – ‘ওগো আমার খোকাদের মেরে ফেললে! ওকে ধরো! ওকে ধরো!’
জোহরার সাথে সাথে সকলে আমগাছতলায় গিয়া দেখিল, ভূত সত্যই আর কেহ নয়, সে জোহরার পিতা। তাহাকে তাহাদের বাস্তুসাপ পদ্ম-গোখরোদ্বয় নির্মমভাবে দংশন করিতেছে এবং ততোধিক নির্মমভাবে সে সর্পদ্বয়কে প্রহার করিতেছে।
জোহরা একবার ‘খোকা’ এবং একবার ‘বাবা’ বলিয়াই মূর্ছিতা হইয়া পড়িল।
জ্ঞান হইলে জোহরা আরিফকে ডাকিল। সকলে সরিয়া গেলে, সে জিজ্ঞাসা করিল- ‘আমার খোকারা কই? আমার পদ্ম-গোখরো? আমার বাবা?’
আরিফ কাঁদিয়া বলিল; ‘জোহরা! জোহরা! কেউ নেই! সব গেছে! সকলে গেছে! তোমার বাবা মরেছেন পদ্ম-গোখরোর কামড়ে!
‘তোমার মা মারা গেছেন কলেরা হয়ে। ওঁরা মক্কা যাচ্ছিলেন। তোমার মা রাস্তায় মারা গেলে, তোমার বাবা অনুতপ্ত হয়ে তোমায় শেষ দেখা দেখতে আসেন লুকিয়ে। লুকিয়েই হয়তো তোমায় দেখে চলে যেতেন। এমন সময় চাকরানি দেখতে পেয়ে ভূত বলে চিৎকার করে! ঠিক সেই সময় তোমার পদ্ম-গোখরো তাঁকে তাড়া করে!’
জোহরা হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, ‘বেশ হয়েছে, জাহান্নামে গেছে ওরা! যাক। আমার পদ্ম-গোখরো – আমার খোকারা কোথায় বলো!’
আরিফ বলিল, ‘তোমার বাবা তাদের মেরে ফেলেছেন!’
জোহরা, ‘এ্যাঁ খোকারা নাই?’ বলিয়াই অজ্ঞান হইয়া পড়িল।
ভোর হইতে না হইতে গ্রামময় রাষ্ট্র হইয়া গেল, মির সাহেবদের সোনার বউ এক জোড়া মরা সর্প প্রসব করিয়া মারা গিয়াছে।
No comments:
Write comments