Search This Blog

Theme images by MichaelJay. Powered by Blogger.

Blog Archive

Saturday, November 12, 2016

মৃত্যুক্ষুধা (২)

গজালের মা-র ছোটোছেলে প্যাঁকালে টাউনের থিয়েটার-দলে নাচে, সখী সাজে, গান করে। কাজও করে –রাজমিস্তিরির কাজ।


বাবু-ঘেঁষা হয়ে সেও একটু বাবু-গোছ হয়ে গেছে। তেড়ি কাটে, ‘ছিকরেট’টানে, পান খায়, চা খায়। পাড়ার মেয়েমহলে তার মস্ত নাম। বলে, - “যেমন গলা, তেমনই গান, তেমনই শৌখিন! ’ঠিয়েটরে’লাচে বাবুদের ঠিয়েটরে, ওই খেরেস্তান পাড়ার যাত্তার গানে লয়। হুঁ হুঁ!”


সে যখন ‘ফুট-গজ’‘কন্নিক’আর ‘সুত’নিয়ে ‘ছিটরেট’টানতে টানতে কাজে যায় আর যেতে যেতে গান ধরে, তখন পাড়ার বউ-ঝিরা ঘোমটা বেশ একটু তুলেই তার দিকে চায়। ‘ভাবি'(বউদি) সম্পর্কের কেউ হয়তো একটু হাসেও। আর অবিবাহিতা মেয়ের মায়েরা আল্লা মিয়াঁকে জোড়া মোরগের গোশতের লোভ দেখিয়ে বলে, “হেই আল্লাজি, আমার কুড়ুনির সাথেই ওর জোড়া লিখো।”


ঘরে সেদিন চা ছিল না। তাই প্যাঁকালে নেদেরপাড়ার বাবুদের বৈঠকখানা হতে একটু চায়ের প্রসাদ পেয়ে এসে কাউকে কিছু না বলেই কন্নিক নিয়ে কাজে বেরিয়ে পড়বার জোগাড় করছিল।


তার মা একটু অনুনয়ের স্বরেই বললে “হ্যাঁ রে, তুই যে কাজে যাচ্ছিস বড়ো? এদিকে যে পাঁচি আমার মরে! দেখ না একটু কাঠুরে পাড়ার দাই মাগিকে। কাল আত্তির(রাত্তির) থেকে কষ্ট খাচ্ছে, এখনও তো কিছু না।”


প্যাঁকালে তখন কন্নিক ফুটগজ সামনে রেখে থালায় একথালা জল নিয়ে ঝুঁকে পড়ে তার তেলচিটে চুলে বেশ করে বাগিয়ে তেড়ি কাটছিল। আয়নায় অভাব সে কিছুদিন থেকে থালার জলেই মিটিয়ে আসছে।


চার আনা দামের একটি আয়না সে কিনেও ফেলেছিল একবার, কিন্তু একদিন চা খাওয়ার পয়সা না থাকাতে সেটা দু পয়সায় বিক্রি করে দোকানে চা খেয়ে এসেছে। এখন যা পায়, তাতে চালই জোটে না দুবেলা, তা আয়না কিনবে কী!


কিছুদিন থেকে সে রোজই তার রোজের পয়সা থেকে চার আনা আলাদা করে রাখে, আর মনে করে আজ একটা আয়না কিনবেই। কিন্তু যেই বাড়িতে এসে বাজার করতে গিয়ে দেখে, ছ আনায় সকলের উপযোগী চালই হয় না, তখন লুকানো সিকিটাও বের করতে হয় কোঁচড় থাকে।


বয়স তার এই আঠারো-উনিশ। কাজেই চেয়ে না-পাওয়ার দুঃখটা ভুলতে আজও তার বেশ একটু সময় লাগে। কিন্তু তার আয়নার জন্য তার পিতৃহীন ছোটো ছোটো ভাইপো ভাইঝিগুলি ক্ষুধিত থাকবে - এ যখন মনে হয়, তখন তার নিজের অভাব আর অভাবই বোধ হয় না।


সেদিন ঝগড়ার ঝোঁকে হিড়িম্বা সবচেয়ে ব্যথা-দেওয়া গাল তার মাকে যেটা দিয়েছিল, সে ওই ‘তিনবেটাখাগি’। সত্যিই তো পাহাড়ের মতো জোয়ান তিন ভাই-ই তার মার চোখের সামনে ধড়ফড়িয়ে মরে গেল! তার ওপর আবার সবার দু-চারটে করে ছেলেমেয়ে আছে; এবং তারা সর্বসাকুল্যে প্রায় এক ডজন।


এই শিশুদের এবং তার বিধবা ভ্রাতৃজায়াদের বোঝা বইবার দায়িত্ব একা তারই। কিন্তু বোঝা তাকে একা বইতে হয় না। তার মা এবং ভ্রাতৃজায়ারা মিলে ও-বোঝা হালকা করবার জন্য দিবারাত্তির খেটে মরে। ওতে বোঝা হালকা হয়তো একটু হয়, কিন্তু ক্লান্তি কমে না। ওরা যেন মস্ত একটা খাড়া পাহাড়ের গড়ানে ‘খাদ’বেয়ে চলেছে, মাথায় এঁটে-দেওয়া বিপুল বোঝা, একটু থামলেই বোঝা-সমেত হুড়মুড় করে পড়বে কোন এক অন্ধকার গর্তে!


গোদের ওপর বিষ-ফোঁড়া! কিছুদিন থেকে আবার ওর ছোটো বোনটাও এসে ওদের ঘাড়ে চড়েছে! বিয়ে দিয়েছিল ওর ভালো বর-ঘর দেখেই! কিন্তু কপালে সুখ লেখা না থাকলে সে কপাল পাথরে ঠুকেও লাভ নেই! ওতে কপাল যথেষ্টই ফোলে, কিন্তু ভাগ্য একটুও ফোলে না – পাঁচির স্বামী নাকি কোন এক ক্যাওরার মেয়েকে মুসলমান করে নেকা করেছে! কিন্তু তার স্বামীর অর্ধেক রাজত্বে পাঁচির মন উঠল না। একদিন তার অনাগত শিশুর শুভ সংবাদসহ অর্ধেক রাজত্বের সর্বস্বত্ব ত্যাগ করে মায়ের দুঃখের কোলেই সে ফিরে এল।


অভাবের দিনে প্রিয় অতিথি আসার মতো পীড়াদায়ক বুঝি আর কিছু নেই! শুধু হৃদয় দিয়ে দেবতার পূজা হয়তো করা যায়, কিন্তু শুধু-হাতে অতিথিকে বরণ করা চলে না। শুধু-হাতের লজ্জা সারা হৃদয় দিয়েও ঢাকা যায় না।


পাঁচি এল চোখ-ভরা জল নিয়ে। দুঃখিনী মা তার চোখের জল মুছাবারও সাহস করলে না। বড়ো আদরের একটি মাত্র মেয়ে তার– তার সর্বকনিষ্ঠ কোল-পোঁছা সন্তান। বুকে সে তুলে নিল তাকে, কিন্তু তাতে শান্তি সে পেল না, বুক তার ফোটে যেতে লাগল কান্নায়, বেদনায়! মা কেঁদে উঠল, “ওরে হতভাগিনি মেয়ে, এ কাঁটার বুকে শুধু যে ব্যাথাই পাবি মা আমার ! এখানে সুখ-শান্তি কোথায়?”


মেয়ের প্রথম সন্তান পিত্রলয়েই হয় –এ-ই দেশের চিরচলিত প্রথা। অতি বড়ো দুঃখীও তার মেয়ে প্রথম সন্তান-সম্ভাবিতা হলে নিজ গিয়ে মেয়েকে আনে, সাধ আরমান করে, মেয়েকে ‘সাধ’খাওয়ায়। পাঁচি যখন প্রসব-বেদনার আর্তনাদ করছিল অথচ অর্থাভাবে ধাত্রীও ডাকতে পারা যাচ্ছিল না কাল রাত্রি থেকে, তখন তার মা-র যন্ত্রণা বুঝছিলেন – যদি বেদনার বোধশক্তি তাঁর থাকে - এক অন্তর্যামী!


নিজে থেকে এসেছে বলেই – এবং মেয়ের কপাল পুড়েছে বলেই কি তার যত্ন-আদরও হবে না একটু? কিন্তু হয় কীসে? –নিঃসম্বল জানি কাঁদে, ছুটে বেড়ায়, কিন্তু করতে কিছুই পারে না।


ছেলের ওপর অভিমান করে কিছুই বলেনি এতক্ষণ, কিন্তু আর সে থাকতে পারল না। ছেলের কাছে এসে কেঁদে পড়ল, “ওরে, পাঁচি যে আর বাঁচে না।”


চা খেয়ে এসেও প্যাঁকালের উষ্মা তখনও কাটেনি। সে তেড়ি কাটতে কাটতে মুখ না তুলেই বলল, “মরুক! আমি তার কী করব? দাইয়ের টাকা দিতে পারবি?”


সত্যিই তো, সে কী করবে! টাকাই বা কোথায় পাওয়া যায়!


হঠাৎ পুত্র তুলে ঝাঁজের সঙ্গে বলে উঠল, “রোজ ঝগড়া করবি নুলোর মা-র সঙ্গে, নইলে সে-ই তো এতখন নিজে থেকে এসে সব করত!”


নুলোর মা আর কেউ নয়, –আমাদের সেই ভীমা প্রখর-দশনা শ্রীমতী হিড়িম্বা! এবং সে শুধু ঝগড়া করতেই জানে না, একজন ভালো ধাত্রীও।


ইতিমধ্যেই পাঁচি চিৎকার করে মূর্ছিতা হয়ে পড়ল। মায়ের প্রাণ, আর থাকতে পারল না। বউদের মেয়েকে দেখতে বলে সে তাড়াতাড়ি হিড়িম্বাকে ডাকতে বেরিয়ে পড়ল।


হিড়িম্বা তখন তার বাড়ির কয়েকটা শশা হাতে নিয়ে বাবুদের বাড়ি বিক্রি করতে যাচ্ছিল। পথে গজালের মা-র সঙ্গে দেখা হতেই সে মুখটা কুঁচকে অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলে। কিন্তু গজালের মা-র তখন তা লক্ষ করবার মতো চোখ ছিল না। সে দৌড়ে হিড়িম্বার হাত দুটো ধরে বললে, “নুলোর মা, আমায় মাফ কর ভাই! একটু দৌড়ে আয়, আমার পাঁচি আর বাঁচে না!”


হিড়িম্বা কথা কয়টা ঠিক বুঝতে না পেরে একটু হতভম্ব হয়ে গেল। সে একটু জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললে, “এ কী ন্যাকামি লা? তুই কি আবার কাজিয়া করবি নাকি পাড়ার মাঝে পেয়ে?”


গজালের মা কেঁদে ফেলে বললে, “না বোন সত্য বলছি, আল্লার কিরে! আমার পাঁচির কাল থেকে ব্যথা উঠেছে; ঝগড়া তোর গজালের মা-র সঙ্গেই হয়েছে, পাঁচির মার সঙ্গে তো হয়নি!”


হিড়িম্বা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললে “অ! তা তোর পাঁচির ছেলে হবে বুঝি? তা আত (রাত) থেকে কষ্ট পাচ্ছে – আর আমায় খবর পাঠাসনি? আচ্ছা মা যাহোক বাবা তুই! আমরা হলে ধন্না দিয়ে পড়তাম গিয়ে। চ দেখি গিয়ে!”


হিড়িম্বা যেতেই পাঁচি কেঁদে উঠল, “মাসি গো, আমি আর বাঁচব না।”


হিড়িম্বা হেসে বললে, “ভয় কী তোর মা; এই তো এখনই সোনার চাঁদ ছেলে কোলে পাবি!”


পাঁচি অনেকটা শান্ত হল। ধাত্রী আসার সান্ত্বনাই তার অর্ধেক যন্ত্রনা কমিয়ে দিল যেন। একটু তদবির করতেই পাঁচির বেশ নাদুস-নুদুস একটি পুত্র ভূমিষ্ঠ হল। সকলে চেঁচিয়ে উঠল, “ওলো, ছেলে হয়েছে লো! ছেলে হয়েছে যে!”


ওদের খুশি যেন আর ধরে না! ওরা যেন ঈদের চাঁদ দেখেছে!


হিড়িম্বা মূর্ছিতাপ্রায় পাঁচির কোলে ছেলে তুলে দিয়ে বললে, “নে, ছেলে কোলে কর। সব কষ্ট জুড়িয়ে যাবে!”


পাঁচি আঝোর নয়নে কাঁদতে লাগল!


নবশিশুর ললাটে প্রথম চুম্বন পড়ল না কারুর, পড়ল দুঃখিনী মায়ের অশ্রুজল!


গজালের মা হিড়িম্বার হাত ধরে বলল, “দিদি, আমায় মাফ কর!”


হিড়িম্বার চোখ ছলছল করে উঠল। সে কিছু না বলে সস্মেহে খোকার কপালে-পড়া তার মায়ের অশ্রুজল-লেখা মুছিয়ে দিলে।


বাইরে তখন ক্রিশ্চান ছেলেদের দেখাদেখি মুসলমান ছেলেরাও গাচ্ছে –


“আমরা জিশুর গুণ গাই।”

No comments:
Write comments

Interested for our works and services?
Get more of our update !