Search This Blog

Theme images by MichaelJay. Powered by Blogger.

Blog Archive

Sunday, November 27, 2016

পরভৃত

পরভৃত


পালিত বলিয়া অপর পাখির নীড়ে


পিকের কন্ঠে এত গান ফোটে কি রে?


মেঘ-শিশু ছাড়ি সাগর-মাতার নীড়


উড়ে যায় হায় দূর হিমাদ্রি-শির,


তাই কি সে নামি বর্ষাধারার রূপে


ফুলের ফসল ফলায় মাটির স্তূপে?


জননী গিরির কোল ফেলে নির্ঝর


পলাইয়া যায় দূর বন-প্রান্তর,


তাই কি সে শেষে হয়ে নদী স্রোতধারা –


শস্য ছড়ায়ে সিন্ধুতে হয় হারা?


বিহগ-জননী স্নেহের পক্ষপুটে


ধরিয়া রাখে না, যেতে দেয় নভে ছুটে


বিহগ-শিশুরে, মুক্ত-কন্ঠে তাই


সে কি গাহে গান বিমানে সর্বদাই?


বেণু-বন কাটি লয়ে যায় শাখা গুণী,


তাই কি গো তাতে বাঁশরির ধ্বনি শুনি?


  


উদয়-অচল ধরিয়া রাখে না বলি


তরুণ অরুণ রবি হয়ে ওঠে জ্বলি!


আড়াল করিয়া রাখে না তামসী নিশা,


তাই মোরা পাই পূর্ণশশীর দিশা।


আকাশ-জননী শূন্য বলিয়া – তার


কোলে এত ভিড় গ্রহ চাঁদ তারকার।


তেমনই আমিনা-জননী শিশুরে লয়ে


‘হালিমা’রহালিমা : হজরত মোহাম্মদের ধাত্রী-মাতা। কোলে ছেড়ে ছিল নির্ভয়ে!


মা-র বুক ত্যজি আসিল ধাত্রীবুকে,


গিরি-শির ছাড়ি এল নদী গুহামুখে!


কেমনে নির্ঝর এল প্রান্তরে বহি


অভিনবতর সে কাহিনি এবে কহি।


  


আরবের যত ‘খাদানি’ ঘরে বহুকাল হতে ছিল রেওয়াজ


নবজাত শিশু পালন করিতে জননী সমাজে পাইত লাজ;


ধাত্রীর করে অর্পিত মাতা জনমিলে শিশু অমনি তায়,


মরু-পল্লিতে স্বগৃহে পালন করিত শিশুরে ধাত্রীমায়।


মরু প্রান্তর বাহি ধাত্রীরা ছুটিয়া আসিত প্রতি বছর,


ভাগ্যবান কে জনমিল শিশু বড়ো বড়ো ঘরে – নিতে খবর।


দূর মরুপারে নিজ পল্লিতে শিশুরে লইয়া তারে তথায়


করিত পালন সন্তানসম যত্নে – পুরস্কার-আশায়।


ঊর্ধ্বে উদার গগন বিথার নিম্নে মহান গিরি অটল,


পদতলে তার পার্বতী মেয়ে নির্ঝরিণীর শ্যামাঞ্চল।


সেই ঝরনার নুড়ি ও পাথর কুড়ায়ে কুড়ায়ে দুই সেই তীর


রচিয়াছে মরু-দগ্ধ আরবি শ্যামল পল্লি শান্ত নীড়।


সেথায় ছিল না নগরের কল-কোলাহল কালি ধূলি-স্তূপ,


ঝরনার জলে ধোয়া তনুখানি পল্লির চির-শ্যামলী রূপ।


সে আকাশতলে সেই প্রান্তরে – সেই ঝরনার পিইয়া জল,


লভিত শিশুরা অটুট স্বাস্থ্য, ঋজুদেহ, তাজা প্রাণ-চপল।


খেলা-সাথি ছিল মেষ-শিশু আর বেদুইন শিশু দুঃসাহস,


মরু-গিরি-দরি চপল শিশুর চরণের তলে ছিল গো বশ।


মরু-সিংহেরে করিত না ভয় এইসব শিশু তিরন্দাজ,


কেশর ধরিয়া পৃষ্ঠে চড়িয়া ছুটাত তাহারে মরুর মাঝ।


আরবি ঘোড়ায় হইয়া সওয়ার বল্লম লয়ে করিত রণ,


মাগিত সন্ধি খেজুর শাখার হাত উঠাইয়া মরু-কানন।


নাশপাতি সেব আনার বেদানা নজরানা দিত ফুল ফলের,


সোজা পিঠ কুঁজো করিয়াছে উট সালাম করিতে যেন তাদের!


‘লু’ হাওয়ায় ছুটে পালাত গো মরু ইহাদেরই ভয়ে দিক ছেয়ে,


রক্ত-বমন করিত অস্ত-সূর্য এরই তির খেয়ে!


  


আরবের যত গানের কবিরা ‘কুলসুম’কুলসুম : ইসলাম পূর্ব কালের আরবদেশীয় এক প্রখ্যাত মহিলা কবি। ‘ইমরুল কায়েস’ইমরুল কায়েস : ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্বেকার অন্ধকার যুগে (আইয়্যাম-ই-জাহিলিসহ) এই কবির মৃত্যুঞ্জয়ী কাব্য ছিল আরববাসীর একমাত্র সান্ত্বনা। আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার যুগেও সুশিক্ষিত সাহিত্যমনস্ক আরবদের মধ্যে তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়। তাঁর অবিনশ্বর কাব্য ‘সাবতা মু-আল্লাহকাহ’ বিগত তিন শতক ধরে ইউরোপের বহু বিদগ্ধ পণ্ডিত ও সমালোচকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা লাভ করেছে।


এই বেদুইন-গোষ্ঠীতে তারা জন্মিয়াছিল এই সে দেশ!


গাহিত হেথাই আলোর পাখি ও গানের কবিতা যত সে গান,


নগরে কেবল ছিল বাণিজ্য, পল্লিতে ছিল ছড়ানো প্রাণ।


আরবের প্রাণ আরবের গান, ভাষা আর বাণী এই হেথাই,


বেদুইনদের সাথে মুসাফির বেশে ফিরিত গো সর্বদাই।


বাজাইয়া বেণু চরাইয়া মেষ উদাসী রাখাল গোঠে মাঠে,


আরবি ভাষারে লীলাসাথি করে রেখেছিল পল্লির বাটে...।


  


যে বছর হল মক্কা নগরে মোহাম্মদের অভ্যুদয়,


দুর্ভিক্ষের অনল সেদিন ছড়ায়ে আরব-জঠরময়।


ঊর্ধ্বে আকাশ অগ্নি-কটাহ, নিম্নে ক্ষুধার ঘোর অনল,


রৌদ্র শুষ্ক হইল নিঝর, তরুলতা শাখা ফুল-কমল।


মক্কা নগরে ছুটিয়া আসিল বেদুইন যত ক্ষুধা-আতুর,


ছাড়ি প্রান্তর, পল্লির বাট খর্জুর-বন দূর মরুর।


বেদুইনদের গোষ্ঠীর মাঝে শ্রেষ্ঠ গোষ্ঠী ‘বনি সায়াদ’,


সেই গোষ্ঠীর ‘হালিমা’ জননী – দুর্ভিক্ষেতে গণি প্রমাদ


আসিল মক্কা, যদি পায় হতে কোনো সে শিশুর ধাত্রী-মা;


খুঁজিতে খুঁজিতে দেখিল, ‘আমিনা-কোল জুড়ি’ চাঁদ পূর্ণিমা,


কোনো সে ধাত্রী লয় নাই এই শিশুরে হেরিয়া পিতৃহীন –


ভাবিল – কে দেবে পুরস্কার এর পালিবে যে ওরে রাত্রিদিন?


শিশুরে হেরিয়া হালিমার চোখে অকারণে কেন ধরে না জল,


বক্ষ ভরিয়া এল স্নেহ-সুধা – শুষ্ক মরুতে বহিল ঢল।


আরবি ভাষার ধাত্রীমা ছিল এই সে গোষ্ঠী ‘বনি সায়াদ’,


এই গোষ্ঠীতে রাখিতে শিশুরে সব সে শরিফ করিত সাধ।


এই গোষ্ঠীর মাঝে থাকি শিশু লভিল ভাষার যে সম্পদ,


ভাবিত নিরক্ষর নবিঘরে সকলে ‘আলেম'আলেম : ইসলাম ধর্মের তাত্ত্বিক পণ্ডিত। মোহাম্মদ।


শিশুরে লইয়া হালিমা জননী চলিল মরুর পল্লি দূর,


ছায়া করে চলে সাথে সাথে তার ঊর্ধ্বে আকাশে মেঘ মেদুর।


নতুন করিয়া আমিনা-জননী কাঁদিলেন হেরি শূন্য কোল,


অদূরে ‘দলিজে'দলিজ : বৈঠকখানায়। মুত্তালিবের শোনা গেল ঘোর কাঁদন-রোল!


পলাইয়া গেল চপল শশক-শিশু শুনি দূর ঝরনা-গান,


বনমৃগ-শিশু পলাল মা ছাড়ি শুনি বাঁশরির সুদূর তান।


বিশ্ব যাঁহার ঘর, সে কি রয় ঘরের কারায় বন্দি গো?


ঘর করে পর অপরের সাথে সেই বিবাগির সন্ধি গো!


শিশু-ফুল হরি নিল বনমালী ফুলশাখা হতে ভোরবেলায়,


লতা কাঁদে, ফুল হেসে বলে, ‘আমি মালা হব মা গো গুণী-গলায়!’


আসিল হালিমা কুটিরে আপন সুদূর শ্যামল প্রান্তরে,


সাথে এল গান শুনাতে শুনাতে বুলবুল পথ-প্রান্তরে।


পাহাড়তলির শ্যাম প্রান্তর হল আরও আরও শ্যামায়মান,


ঊর্ধ্বে কাজল মেঘ-ঘন-ছায়া, সানুদেশে শ্যামা দোয়েল গান!


  


তরুণ অরুণ আসিল আকাশে ত্যজিয়া উদয়-গিরির কোল,


ওরে কবি, তোর কন্ঠে ফুটুক নতুন দিনের নতুন বোল!

No comments:
Write comments

Interested for our works and services?
Get more of our update !