Search This Blog

Theme images by MichaelJay. Powered by Blogger.

Blog Archive

Sunday, November 13, 2016

রিক্তের বেদন - খ

রেলপথে


(অণ্ডালের কাছাকাছি।)


  


যাক, এতক্ষণে লোকের ভক্তিশ্রদ্ধার আক্রমণ হতে রেহাই পাওয়া গেল! – উঃ, যুদ্ধের আগেই এও তো একটা মন্দ যুদ্ধ নয়, রীতিমতো দ্বন্দ্ব যুদ্ধ! এখন একটু হাঁফ – ছেড়ে বাঁচি। ...


একটা ভালো কাজ করে যা আনন্দ আর আত্মপ্রসাদ মনে মনে লাভ করা যায়, তার অনেকটা নষ্ট করে দেয় বাইরের প্রশংসায়।


সব চেয়ে বেশি ভিড় হয়েছিল কলকাতায় আর হাবড়ার স্টেশনে। – ওঃ, সে কী বিপুল জনতা আর সে কী আকুল আগ্রহ আমাদিগকে দেখবার জন্যে! আমরা মঙ্গলগ্রহ হতে অথবা ওই রকমের স্বর্গের কাছাকাছি কোনও একটা জায়গা হতে যেন নেমে আসছি আর কী! যাঁদের সঙ্গে তখনও আলাপ করবারও সুযোগ পাইনি, তাঁরাও আমাদের সঙ্গে কোলাকুলি করেছেন আর অশ্রুগদগদ কণ্ঠে আশিস করেছেন। – ওই যে হাজার হাজার পুর-মহিলার হৃদয় গলে সহানুভূতির পূত অশ্রু ঝরছে, ওতেই আমাদের ভবিষ্যৎ মঙ্গল সূচিত হচ্ছে! – সকলেরই দৃষ্টি আজ কত স্নেহ-আর্দ্র কোমল! ... ...


স্টেশনে স্টেশনে এই যে উপহারের আর বিদায়-সম্ভাষণের ধুমধাম, এতে কিন্তু বড্ডো বেশি ব্যতিব্যস্ত করে ফেলছে! – এ সব রাজ্যের জিনিস খাবে কে? – আহা, না, না, এই রকম উপহার দিয়েই যদি ওরা তৃপ্ত হয়, একটা অশ্রুময় গৌরবে বক্ষ ভরে ওঠে, তবে তাই হোক!


মন! বুঝে নাও কী জন্যে এত ভক্তি-শ্রদ্ধা। ভেবে নাও কী ঘোর দায়িত্ব মাথায় করছ!


আমার কম্পিত বুকে থেকে থেকে এখনও সেই আর্ত বন্দনার ঘন প্রতিধ্বনি হচ্ছে, ‘বন্দে মাতরম্ – বন্দে মাতরম্।’


রেলগাড়ি


(নিশি ভোর)


  


কী সুন্দর জলে-ধোয়া আকাশ! কী স্নিগ্ধ নিঝুম নিশি-ভোর! সারা প্রকৃতি এখনও তন্দ্রালস নয়নে গা এলিয়ে দিয়ে পড়ে রয়েছে। গোলাবি রং-এর মসলিনের মতো খুব পাতলা একটা আবছায়া তার ধূমভরা ক্লান্ত দেহটায় জড়িয়ে রয়েছে। আর একটু পরেই এমন সুন্দর প্রকৃতি বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে জেগে উঠবে, তারপরে সেই তেমনই নিত্যকার গোলমাল!


(ওই প্রত্যুষে)


  


এখন বোধ হচ্ছে যেন সমস্ত দেশটা এইমাত্র বিছানা ছেড়ে উঠে উদাস-অলস নয়নে তার চেয়েও উদার আকাশটার দিকে চেয়ে রয়েছে! এখনও তার আঁখির পাতায় পাতায় ঘুমের জড়িমা মাখানো! হাইতোলার মতো মাঝে মাঝে দমকা বাতাস ছুটে আসছে!


পাকা তবলচির মতো রেলগাড়িটা কী সুন্দর কারফা বাজিয়ে যাচ্ছে, ‘পাঁটা কেটে ভাগ দিন – পাঁটা কেটে ভাগ দিন!’ ইচ্ছে করছে রেল-চলার এই কারফা তালের তালে তালে একটা ভৈরোঁ কী টোড়ি রাগিণী ভাঁজি, কিন্তু গান গাইবার মতো এখন আদৌ সুর নেই যেন আমার কণ্ঠে।


মধুপুর


  


নিশি শেষের গ্যাসের আলো পড়ে আমাদের মুখগুলো কী করুণ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। ওই ফ্যাকাসে আলোর পাণ্ডুর আভা প্রতিভাত হয়ে আমার ঘুমন্ত সৈনিক-বন্ধুদের সিক্ত নয়ন-পল্লবগুলি কীরকম চকচক করছে! ও কীসের অশ্রুবিন্দু! বিদায়-ব্যথার? – কে জানে! ....


আজ এই প্রভাতের গ্যাসের আলোর মতোই পান্ডুর রক্তহীন একটি তরুণ মুখ ক্ষণে ক্ষণে আমার বুকের মাঝে ভেসে উঠছে। এখন যেন একটা বাষ্পময় কুয়াশার মতো আধো-আলো আধো-আঁধার ভাব দেখা যাচ্ছে, কদিন ধরে তার দৃষ্টিটিও এই রকম ঝাপসা সজল হয়ে উঠেছিল! সে কিন্তু কখনও কিছু বলেনি – কিছু বলতে পারেনি – আমিও কখনও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি – হাজার চেষ্টাতেও না! কী যেন একটা লজ্জামিশ্রিত কিছু আমায় প্রাণপণে চোখমুখ ঢেকে মানা করত – না, না, না, তবু কী করে আমাদের দুটি প্রাণের গোপন কথা দুজনেই জেনেছিলুম। ওঃ, প্রথম যৌবনের এই গোপন ভালোবাসাবাসির মাধুর্য কত গাঢ়! আমার বিদায় দিনেও আমি একটি মুখের কথা বলতে পারিনি তাকে! শুধু একটা জমাট অশ্রুখণ্ড এসে আমার বাকরোধ করে দিয়েছিল! সেও কিছু বলেনি, যতদিন বাড়িতে ছিলুম, ততদিন শুধু লুকিয়ে কেঁদেছে আর কেঁদেছে! তার পর বিদায়ের ক্ষণে তাদের ভাঙা দেয়ালটা প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রক্তভরা আঁখিতে ব্যাকুল বেদনায় চেয়েছিল! আর তার তরুণ সুন্দর মুখটি এই ভোরের গ্যাসের আলোর মতোই করুণ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল! – মা যেন আমার গোপন-ব্যথার রক্ত ক্ষরা দেখেই সেদিন বলেছিলেন, ‘যা বাপ, একবার শাহিদাকে দেখা করে আয়। সে মেয়ে তো কেঁদে কেঁদে একেবারে নেতিয়ে পড়েছে!’ – আমি তখন জোর করে বলেছিলুম, ‘না, মা, মরুকগে সে, আমি কিছুতেই দেখা করতে পারব না।’ – হায় রে, খামখেয়ালির অহেতুক অভিমান!


আজ বড়ো দুঃখে আমার সেই প্রিয় গানটা মনে পড়ছে, –


‘দুজনে দেখা হল মধু-যামিনীরে –


কেন কথা কহিল না – চলিয়া গেল ধীরে?


নিকুঞ্জে দখিনাবায়, করিছে হায় হায় –


লতাপাতা দুলে দুলে ডাকিছে ফিরে ফিরে! –


দুজনের আঁখিবারি গোপনে গেল বয়ে –


দুজনের প্রাণের কথা প্রাণেতে গেল রয়ে –


আর তো হল না দেখা জগতে দোঁহে একা,


চিরদিন ছাড়াছাড়ি যমুনা-তীরে!’ –


  


উঃ, কী পানসে উদাস আজকার ভোরের বাংলাটা! – সদ্যসুপ্তোত্থিত বনের বিহগের আনন্দ-কাকলি আজ যেন কী রকম অশ্রুজড়িত আর দীর্ঘ ব্যথিত।


এই গাড়ি ছাড়ার ঘন্টার ঢং ঢং শব্দটা কত অরুন্তুদ গভীর! ঠিক যেন গির্জায় কোনো অতীত হতভাগার চির বিদায়ের শেষ ঘন্টাধ্বনি!


লাহোরের অদূরে


(নিশীথ)


  


একটা বিরাট মহিষাসুরের মতো কী একরোখা ছুট ছুটছে এই উন্মাদ বাষ্প-রথটা! ... ছোটো, ... ওগো আগুন আর বাষ্প-পোরা-দানব, ছোটো! আর দোল দাও – দোল দাও এই তরুণ তোমার ভাইদের! ছোটো, ওগো খ্যাপা দৈত্য, ছোটো, – আর পিষে দিয়ে যাও তোমার এই লৌহময় পথটাকে! তোমার পথের পাশে ঘুমিয়ে যারা, তাদের জাগিয়ে দিয়ে যাও তোমার এই ছোটার শব্দে!...


নিশীথের জমাট অন্ধকার চিরে শান্ত বনশ্রীকে চকিত শঙ্কিত করে কত জোরে ছুটেছে এই খামখেয়ালি মাথাপাগলা রাক্ষসটা, – কিন্তু তার চেয়েও লক্ষ গুণ বেগে আমার মন উলটোদিকে ছুটেছে – যেখানে আমার সেই গোপন আকাঙ্ক্ষিতার বাষ্পরুদ্ধ চাপাকান্নার আকুলতা গ্রামের নিরীহ অন্ধকারকে ব্যথিত ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে! মন আমার তারই সাথে শ্বাস ফেলাচ্ছে, সে হতভাগিনির ফুলে-ফুলে-উঠা দীর্ঘশ্বাস সরল-মেঠো বাতাসটিকে নিষ্ঠুরভাবে আহত করছে! আলুথালু আকুলকেশ, ধূলি-লুণ্ঠিত শিথিল-বসন, উজাড় করে দেওয়া আঁশুয়ে ভেজা উপাধান, – সব যেন মনের চোখে দেখতে পাচ্ছি আর এই মধু-কল্পনার স্নিগ্ধকারুণ্য আমার বুকে কেমন একটি গৌরবের ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে!


সমস্ত শাল আর পিয়াল বন কাঁপিয়ে যেন একটা পুত্রশোকাতুরা দৈত্য-জননী ডুকরে ডুকরে কাঁদছে ‘ওই – ওই – ওই!’ আর মাতৃহারা দৈত্যশিশুর মতো এই খ্যাপা গাড়িটাও এপার থেকে কাতরে কাতরে উঠচে উ – উ – উঃ!

No comments:
Write comments

Interested for our works and services?
Get more of our update !