সেদিন রাস্তা দিয়ে গফরগাঁও-এর জমিদারদের হাতি যাচ্ছিল। নূরজাহান বেড়ার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। বেচারা সবুরও হাতি দেখার লোভ সংবরণ করতে না পেরে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। অদূরে সদলবলে রুস্তম দাঁড়িয়ে ছিল। সে হাতিটার দিকে দেখিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘এরিও তালবিল্লি মিয়াঁ গো! হুই তোমাগ বাছুরডা আইতেছে, ধইরা লইয়াও।’ রাস্তার সকলে হেসে গড়িয়ে পড়ল। রাস্তার একটা মেয়ে বলে উঠল, ‘বিজাত্যার পোলাডা! হাতিডা বাছুর না, বাছুর তুই!’ ভাগ্যিস রুস্তম শুনতে পায়নি।
নূরজাহান তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। সে যত না রাগল ছেলেগুলোর উপর, তার অধিক রেগে উঠল সবুরের উপর। সে প্রতিজ্ঞা করল মনে মনে, আজ তাকে দুটো কথা শুনিয়ে দেবে। এই কী পুরুষ! মেয়েছেলেরও অধম যে!
সেদিন সন্ধ্যায় যখন পড়াতে গেল সবুর, তখন কোনো ভূমিকা না করে নূরজাহান বলে উঠল, ‘আপনি বেডা না? আপনারে লইয়া ইবলিশা পোলাপান যা তা কইব আর আপনি হুইন্যা ল্যাজ গুডাইয়া চইলা আইবেন? আল্লায় আপনারে হাত-মুখ দিছে না।’
সবুর আজ যেন ভুলেই তার ব্যথিত চোখ দুটি নূরজাহানের মুখের উপর তুলে ধরল! কিন্তু চোখ তুলে যে রূপ সে দেখলে, তাতে তার ব্যথা লজ্জা অপমান সব ভুলে গেল সে। দুই চোখে তার অসীম বিস্ময় অনন্ত জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল। এই তুমি! সহসা তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল – ‘নূরজাহান!’
নূরজাহান বিস্ময়-বিমূঢ়ার মতো তার চোখের দিকে চেয়ে ছিল। এ কোন বনের ভীরু হরিণ? অমন হরিণ-চোখ যার, সে কি ভীরু না হয়ে পারে? নূরজাহান কখনও সবুরকে চোখ তুলে চাইতে দেখেনি। সে রাস্তা চলতে কথা কইত – সব সময় চোখ নিচু করে। মানুষের চোখ যে মানুষকে এত সুন্দর করে তুলতে পারে – তা আজ সে প্রথম দেখল।
সবুরের কন্ঠে তার নাম শুনে লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে উঠল। বর্ষারাতের চাঁদকে যেন ইন্দ্রধনুর শোভা ঘিরে ফেলল।
আজ চিরদিনের শান্ত সবুর চঞ্চল মুখর হয়ে উঠেছে। প্রশান্ত মহাসাগরে ঝড় উঠেছে। মৌনী পাহাড় কথা কয় না, কিন্তু সে যেদিন কথা কয়, সেদিন সে হয়ে উঠে অগ্নিগিরি।
সবুরের চোখে মুখে পৌরুষের প্রখর দীপ্তি ফুটে উঠল। সে নূরজাহানের দিকে দীপ্ত চোখে চেয়ে বলে উঠল, ‘ওই পোলাপানেরে যদি জওয়াব দিই, তুমি খুশি হও?’ নূরজাহানও চকচকে চোখ তুলে বলে উঠল, ‘কে জওয়াব দিব? আপনি?’
এ মৃদু বিদ্রুপের উত্তর না দিয়ে সবুর তার দীর্ঘায়ত চোখ দুটির জ্বলন্ত ছাপ নূরজাহানের বুকে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল। নূরজাহান আত্মবিস্মৃতের মতো সেইখানে বসে রইল। তার দুটি সুন্দর চোখ আর ততোধিক সুন্দর চাউনি ছাড়া আর কোনো কিছু মনে রইল না! যে সবুরকে কেউ কখনও চোখ তুলে চাইতে দেখেনি, আজ সে উজ্জ্বলচোখে, দৃপ্তপদে রাস্তায় পায়চারি করছে দেখে সকলে অবাক হয়ে উঠল।
রুস্তমিদল গাঙের পার থেকে বেড়িয়ে সেই পথে ফিরছিল।হঠাৎ ফজল চিৎকার করে উঠল – ‘উইরে তালবিল্লি।’
সবুর ভলো করে আস্তিন গুটিয়ে নিল।
বারি পিছু দিক থেকে সবুরের মাথায় ঠোকর দিয়ে বলে উঠল, ‘প্যাঁচারে, তুমি ডাহো।’
সবুর কিছু না বলে এমন জোরে বারির এক গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলে যে, সে সামলাতে না পেরে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল। সবুরের এ অপ্রত্যাশিত ব্যবহারে দলের সকলে কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
সবুর কথাটি না বলে গম্ভীরভাবে বাড়ির দিকে যেতে লাগল। বারি ততক্ষণে উঠে বসেছে। উঠেই সে চিৎকার করে উঠল – ‘সে হালায় গেল কোই?’
বলতেই সকলের যেন হুঁশ ফিরে এল। মার মার করে সকলে গিয়ে সবুরকে আক্রমণ করলে। সবুরও অসম সাহসে তাদের প্রতি-আক্রমণ করলে। সবুরের গায়ে যে এত শক্তি, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। সে রুস্তমি দলের এক এক জনের টুঁটি ধরে পাশের পুকুরের জলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে লাগল।
আলি নসিব মিয়াঁর এই পুকুরটা নতুন কাটানো হয়েছিল, আর তার মাটিও ছিল অত্যন্ত পিছল। কাজেই যারা পুকুরে পড়তে লাগল গড়িয়ে – তারা বহু চেষ্টাতেও পুকুরের অত্যুচ্চ পাড় বেয়ে সহজে উঠতে পারল না। পা পিছলে বারে বারে জলে পড়তে লাগল গিয়ে। এইরূপে যখন দলের পাঁচ ছয় জন, মায় রুস্তম সর্দার জলে গিয়ে পড়েছে – তখন রুস্তমিদলের আমির তার পকেট থেকে দু-ফলা ছুরিটা বের করে সবুরকে আক্রমণ করল। ভাগ্যক্রমে প্রথম ছুরির আঘাত সবুরের বুকে না লেগে হাতে গিয়ে লাগল। সবুর প্রাণপণে আমিরের হাত মুচড়ে ধরতেই সে ছুরি সমেত উলটে পড়ে গেল এবং আমিরের হাতের ছুরি আমিরেরই বুকে আমূল বিদ্ধ হয়ে গেল। আমির একবার মাত্র ‘উঃ” বলেই অচৈতন্য হয়ে গেল! বাকি যারা যুদ্ধ করছিল – তারা পাড়ায় গিয়ে খবর দিতেই পাড়ার লোক ছুটে এল। আলি নসিব মিয়াঁও এলেন।
সবুর ততক্ষণে তার রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত ক্লান্ত শরীর নিয়েই আমিরকে কোলে তুলে নিয়ে তার বুকের ছুরিটা তুলে ফেলে সেই ক্ষতমুখে হাত চেপে ধরেছে। আর তার হাত বেয়ে ফিনিক দিয়ে রক্ত-ধারা ছুটে চলছে!
আলি নসিব মিয়াঁ তাঁর চক্ষুকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি দুই হাত দিয়ে তাঁর চক্ষু ঢেকে ফেললেন।
একটু পরে ডাক্তার এবং পুলিশ দু-ই এল। আমিরকে নিয়ে ডাক্তারখানায়, সবুরকে নিয়ে গেল থানায়।
সবুরকে থানায় নিয়ে যাবার আগে দারোগাবাবু আলি নসিব মিয়াঁর অনুরোধে তাকে একবার তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সে দারোগাবাবুর কাছে একটুও অতিরঞ্জিত না করে সমস্ত কথা খুলে বললে। তার কথা অবিশ্বাস করতে কারুরই প্রবৃত্তি হল না। দারোগাবাবু বললেন, ‘কেস খুব সিরিয়স নয়, ছেলেটা বেঁচে যাবে। এ কেস আপনারা আপসে মিটিয়ে ফেলুন সাহেব।’
আলি নসিব মিয়াঁ বললেন, আমার কোনো আপত্তি নাই দারোগা সাহেব, আমিরের বাপে কি কেস মিটাইব? তারে তো আপনি জানেন। যারে কয় এক্কেরে বাঙাল!’
দারোগাবাবু বললেন ‘দেখা যাক, এখন তো ওকে থানায় নিয়ে যাই। কী করি, আমাদের কর্তব্য করতেই হবে।’
ততক্ষণে আলি নসিব মিয়াঁর বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেছে। এই খবর শুনেই নূরজাহান মূর্ছিতা হয়ে পড়েছিল। আলি নসিব মিয়াঁ সবুরকে সাথে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, তখন নূরজাহান একেবারে প্রায় সবুরের পায়ের কাছে পড়ে কেঁদে উঠল, ‘কে তোমারে এমনডা করবার কইছিল? কেন এমনডা করলে?’
নূরজাহানের মা সবুরকে তার গুণের জন্য ছেলের মতোই মনে করতেন। তা ছাড়া, তাঁর পুত্র না হওয়ায় পুত্রের প্রতি সঞ্চিত সমস্ত স্নেহ গোপনে সবুরকে ঢেলে দিয়েছিলেন। তিনি সবুরের মাথাটা বুকের উপর চেপে ধরে কেঁদে আলি নসিব মিয়াঁকে বললেন, ‘আমার পোলা এ, আমি দশ হাজার ট্যাহা দিবাম, দারোগাব্যাডারে কন, হে এরে ছ্যাইরা দিয়া যাক।’
সবুর তার রক্তমাখা হাত দিয়ে নূরজাহানকে তুলে বলে উঠল, ‘আমি যাইতেছি ভাই! যাইবার আগে দেহাইয়া গেলাম – আমিও মানুষের পোলা। এ যদি না দেহাইতাম, তুমি আমায় ঘৃণা করতা। খোদায় তোমায় সুখে রাখুন!’ বলেই তার মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বললে ‘আম্মাগো এই তিনডা বছরে আপনি আমায় মায়ের শোক ভুলাইছিলেন।’ আর সে বলতে পারল না – কান্নায় তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল।’
আলি নসিব মিয়াঁর পদধূলি নিয়ে সে নির্বিকারচিত্তে থনায় চলে গেল। দারোগাবাবু কিছুতেই জামিন দিতে রাজি হলেন না। দশ হাজার টাকার বিনিময়েও না, খুনি আসামিকে ছেড়ে দিল তাঁর চাকরি যাবে।
নূরজাহানের কানে কেবল ধ্বনিত হতে লাগল, ‘তুমি আমায় ঘৃণা করতে।’ তার ঘৃণায় সবুরের কী আসত যেত? কেন সে তাকে খুশি করবার জন্য এমন করে ‘মরিয়া হইয়া’ উঠল? সে যদি আজ এমন করে না বলত সবুরকে, তা হলে কখনই সে এমন কাজ করত না। এমন নির্যাতন তো সে তিন বছর ধরে সয়ে আসছে। তারই জন্য আজ সে থানায় গেল। দু-দিন পরে হয়তো তার জেল, দ্বীপান্তর – হয়তো বা তার চেয়ে বেশি – ফাঁসি হয়ে যাবে! ‘উঃ’ বলে আর্তনাদ করে সে মূর্ছিতা হয়ে পড়ল।
আলি নসিব মিয়াঁ যেন আজ এক নতুন জগতের সন্ধান পেলেন। আজ সবুর তার দুঃখ দিয়ে তাঁর সুখের বাকি দিনগুলোকেও মেঘাচ্ছন্ন করে দিয়ে গেল! একবার মনে হল, বুঝি বা দুধ-কলা দিয়ে তিনি সাপ পুষেছিলেন! পরক্ষণেই মনে হল সে সাপ নয়, সাপ নয়! ও নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক ! আর – যদি সাপই হয় – তা হলেও ওর মাথায় মনি আছে ! ও জাত-সাপ।
হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে গেল, তাঁর অনুকম্পায় প্রতিপালিত হলেও বংশ-মর্যাদায় সবুর তাঁদের চেয়েও অনেক উচ্চে। আজ সে দরিদ্র, পিতৃমাতৃহীন নিঃসহায় – কিন্তু একদিন এদেরই বাড়িতে আলি নসিব মিয়াঁর পূর্বপুরুষেরা নওকরি করেছেন। তা ছাড়া এই তিন বছর তিনি সবুরকে যে অন্ন বস্ত্র দিয়েছেন তার বিনিময়ে সে তাঁর কন্যাকে উর্দু ও ফার্সিতে যে কোনো মাদ্রাসার ছেলের চেয়েও পারদর্শিনী করে দিয়ে গেছে। আলি নসিব মিয়াঁ নিজে মাদ্রাসা-পাশ হলেও মেয়ের কাছে তাঁর উর্দু ফারসি সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে ভয় হয়। সে তো এতটুকু ঋণ রাখিয়া যায় নাই। শ্রদ্ধায় প্রীতিতে পুত্রস্নেহে তাঁর বুক ভরে উঠল।... যেমন করে হোক, ওকে বাঁচাতেই হবে!
নিজের জন্য নয়, নিজের চেয়েও প্রিয ওই কন্যার জন্য! আজ তো আর তাঁর মেয়ের মন বুঝতে আর বাকি নেই। অন্যের ঘরে পাঠাবার ভয়ে মেয়ের বিয়ের নামে শিউরে উঠেছেন এতদিন, আজ যদি এই ছেলের হাতে মেয়েকে দেওয়া যায় – মেয়ে সুখী হবে, তাকে পাঠাতেও হবে না অন্য ঘরে। সে-ই তো ঘরের ছেলে হয়ে থাকবে। উচ্চশিক্ষা? মাদ্রাসার শেষ পরীক্ষা তো সে দিয়েইছে – পাশও করবে সে হয়তো সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে। তার পর কলেজে ভর্তি করে দিলেই হবে।
এই ভবিষ্যৎ সুখের কল্পনা করে – আলি নসিব মিয়াঁ অনেকটা শান্ত হলেন এবং মেয়েকেও সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। সে রাত্রে নূরজাহানের আর মূর্ছা হল না, সে ঘুমাতেও পারল না। সমস্ত অন্ধকার ভেদ করে তার চোখে ফুটে উঠতে লাগল – সেই দুটি চোখ, দুটি তারার মতো! প্রভাতি তারা আর সন্ধ্যাতারা।
No comments:
Write comments